‘লুচি বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলল’

ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মাহবুবুর রহমান সুজন (৪২) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের স্বজনরা বলছেন, সুজন ঝুট কাপড় ব্যবসায়ী। পুলিশের দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় তাকে বাসা থেকে ধরে থানায় নিয়ে পেটাতে পেটাতে হত্যা করা হয়। অপর দিকে পুলিশ বলছে, সুজন সন্ত্রাসী দলের সদস্য। গত শনিবার রাতে তাকে নিয়ে অপর সন্ত্রাসী ধরতে অভিযান চালানোর সময় গাড়ির ভেতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় মিরপুর থানার এসআই জাহিদকে কোজ করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে মিরপুর জোনের পুলিশের এডিসিকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহত সুজনের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুচি হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, তার স্বামী মিরপুর-শাহআলী এলাকায় গার্মেন্টের ঝুট কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সে সময় তিনি পুলিশকে প্রতিমাসে ২৫ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতেন। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশ তার কাছ থেকে মাসে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করতে থাকে। সুজন ওই টাকা দিতে না পারায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা ঠুকে দেয়। পুলিশের ভয়ে গত ১০ মাস আগে ছেলে মোশাররফ (৫) ও মেয়ে লামিয়াকে (৯) নিয়ে মিরপুর সেকশন-১, ব্লক-ই, রোড-৯, বাড়ি-১৫ ছেড়ে হাজারীবাগ থানাধীন শঙ্করের ১৫ নম্বর রোডের ২৭৭ নম্বর বাসায় উঠেন। লুচি আরো বলেন, গত শনিবার রাত ১২ টার দিকে মিরপুর থানার এসআই জাহিদসহ চার-পাঁচজন সাদা পোশাকধারী তাদের বাসায় নক করে। কে জানতে চাইলে বাইর থেকে বলা হয় ‘আমরা সুজনের বন্ধু। ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি’। এরপর দরজা খুলে দিলে এসআই জাহিদসহ পাঁচ-ছয়জন হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে। জাহিদকে চিনতে পেরে সুজন স্টোর রুমে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ সময় জাহিদ লুচিকে বলেন ‘তোর স্বামী কোথায়? লুচি বলেন, বাসায় নেই। পরে জাহিদ লুচির চুলের মুঠি ধরে মারধর শুরু করে। মাকে মারতে দেখে পাঁচ বছরের মোশাররফ চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ঘটনার সময় মেয়ে লামিয়া ছিল তার নানুর বাসায়। ছেলের কান্না ও স্ত্রীকে মারতে দেখে সুজন স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ তাকে দেখে ফেলে। পরে তারা স্ত্রী ও সন্তানের সামনে সুজনকে ধরে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলে। পরে তাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। সেখানে বেধড়ক মারধর করে সুজনকে।
লুচি আরো অভিযোগ করেন, সুজনকে মারধর করার পর পুলিশ তাদের তিনজনকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে লুচি ও ছেলে মোশাররফকে একটি রুমে রাখা হয়। সুজনকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য একটি রুমে। লুচি বলেন, পাশের রুম থেকে আমি শুনতে ছিলাম আমার স্বামী বাঁচার জন্য পুলিশকে বাপ বলে চিৎকার করছে। তখন রাত কত হবে জানি না। একপর্যায়ে আমার স্বামী চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, লুচি আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেলল। এর কিছু সময় পর সব কিছু নীরব হয়ে যায়। পুলিশের মারধরের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় তার স্বামীর চিৎকার। পরে পুলিশ তাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। সকালে পুলিশ লুচিকে জানায়, তার স্বামী ঢাকা মেডিক্যালে রয়েছে। সেখানে ছুটে গিয়ে মর্গে স্বামীর লাশ দেখতে পান। লুচি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মৃত্যুর সময় কাছে থেকেও স্বামীকে দেখতে পারলাম না। কতটা কষ্ট দিয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে তা আমি অনুভব করতে পারছি।
নিহতের ভাই শামীম জানান, পুলিশকে টাকা দিয়েই ঝুট ব্যবসা করতে হয়। সুজনও তাই করছিল। কিন্তু পুলিশের চাহিদা এতটা বেড়ে যায় যে সুজন তা দিতে পারেনি। এরপর থেকে সুজনের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিতে থাকে পুলিশ। কিছু দিন আগে সুজনের ভাই সবুজের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দেয় পুলিশ। পুলিশের ভয়ে সুজন বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। তারপরও বাঁচতে পারেনি। পুলিশ ঠিকই তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করেছে।
এ দিকে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, শনিবার জাকির এবং মিঠুন নামে দুইজনকে ১৪৫ পিস ইয়াবাসহ মিরপুর থেকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা সুজন সম্পর্কে তথ্য দেয়। সুজন শাহ আলী থানার ৫১ নম্বর তালিকাভুক্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসী এবং পলাতক আসামি। তিনি আরো জানান, জাকির ও মিঠুনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাজারীবাগ থানা পুলিশের সহায়তায় শনিবার রাতে সুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে দুইটি ম্যাগজিন ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে সুজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সাদা বাবু নামে আরেকজনের তথ্য পাওয়া যায়। সাদা বাবুকে ধরতে ওই রাতেই সুজনকে নিয়ে অভিযানে বের হয় পুলিশ। পথের মধ্যে সুজনের শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিলে তাকে মিরপুর একনম্বর লতিফা হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সুজনের মাথায়, দুই হাত ও দুই পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ দিকে এই ঘটনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। জানা গেছে, পুলিশের মিরপুর বিভাগের এডিসি জসিম উদ্দীনকে প্রধান করে মিরপুর জোনের এসি সাখাওয়াত হোসেন ও মিরপুর বিভাগের এসি (প্রশাসন) তোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে এ কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মিরপুর বিভাগের ডিসি ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।