দুই কোটি টাকার চুক্তিতে একরাম হত্যা!

akaram h_25369_0সুরমা টাইমস ডেস্কঃ দুই কোটি টাকার বিনিময়ে একরামকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে গ্রেপ্তাররা।তাদের দাবি, একরাম হত্যার বিনিময়ে দুই কোটি টাকা ‘মূল্য’ পরিশোধ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।
একরাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার জন স্বীকার করেছেন, স্থানীয় আওয়ামী নেতারা ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার জন্য ভাড়া করা পেশাদার গুণ্ডা ও জলদস্যুদের দুই কোটি টাকা দিয়েছেন।
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, একরাম হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আনোয়ার, আলাউদ্দিন, ইকবাল ও সাখাওয়াত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর এক সপ্তাহ আগে ফেনী শহরের কালাম কমিউনিটি সেন্টারে বসে এক গোপন বৈঠকে পুরো পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল। ওই বৈঠকে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আদিল, স্থানীয় নেতা জাহিদুল ইসলাম, ওয়ার্ড কাউন্সিলর শিপলুসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেপ্তাররা জানান, একরামকে হত্যা করার জন্য দুই কোটি টাকা খরচ করে একে-৪৭ বন্দুক এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে- এমন সশস্ত্র অপরাধীদের ভাড়া করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ওই বৈঠকে। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র অপরাধী হিসেবে ব্রিঞ্চি ও আশপাশের অন্যান্য এলাকা গুণ্ডাপাণ্ডা ছাড়াও সোনাগাজীর জলদস্যুদের ভাড়া করা হয় এবং হত্যাকাণ্ডের আগেই অগ্রিম হিসেবে তাদের এক কোটি টাকাও দেয়া হয়।
এসব তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একরাম হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, মামলাসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়ে গেছে এবং তদন্তের ফলাফল আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সংবাদমাধ্যমের সামনে পেশ করা হবে।
এদিকে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার দৃশ্য সম্বলিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা নিজাম উদ্দিন হাজারী।
শতাধিক স্থানীয় ব্যক্তির সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটানো হত্যাকাণ্ডের এই দৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরাই। ভিডিও ফুটেজটি বিশ্লেষণ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম এবং অভিযুক্ত অপরাধী আবিদ, হুমায়ূন ও সোহেল ওরফে রুটি সোহেলসহ অন্তত মোট চার জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে যাদের চিহ্নিত করা সম্ভব তাদের মধ্যে জাহিদুল ইসলামকে দেখা গেছে হামলার নেতৃত্ব দিতে।
জানা গেছে, নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহিদের সঙ্গে একরামুলের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কারণ নিহত নেতা একরামুল এর আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলাকালীন ফুলগাজী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে জাহিদকে বহিষ্কার করেছিলেন।
২০০০ সালে যুবলীগ নেতা বশির হত্যার অভিযুক্ত আসামি এই জাহিদ ফুলগাজী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সে সময় বহিষ্কৃত হলেও পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সহায়তায় ওই পদটি আবার ফিরেও পেয়েছিলেন।
ভিডিও ক্লিপ থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এমন আও একজন ব্যক্তি হলেন আবিদ। ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিনের ছেলে আবিদ সম্পর্কে আবার নিজাম হাজারীর ভাইও হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একরামের ওপর হামলা চালানোর সময়ে আবিদ মুখোশ পরে থাকলেও তার শরীরি অঙ্গভঙ্গি এবং হাঁটার ধরন দেখেই তার পরিচয় সম্পর্কে পরিষ্কারভাবেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিজামের হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত এই আবিদই একরামের ওপরে প্রথম গুলিটি চালিয়েছিলেন।
এদিকে অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সিআইডির একটি দলও এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রমাণ যোগাড় করেছে। এসব প্রমাণের মধ্যে পুড়ে যাওয়া একটি ৭.৬২ এমএম পিস্তল, একটি নতুন ছুড়ির অংশবিশেষ, একরামকে বহনকারী গাড়ির পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ এবং একটি ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার রয়েছে।
একরামকে গুলি করার আগে এবং তাকেসহ গাড়িটি পুড়িয়ে দেয়ার আগে হামলাকারীরা তার গাড়িতে এবং তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়েও আঘাত করেছিল বলে জানা গেছে। কারণ গাড়িতে এবং আসনগুলোতেও ধারালো অস্ত্রের কোপানো হয়েছে এমন সাত থেকে আটটি দাগ পাওয়া গেছে।
সিআইডি আরও জেনেছে যে, যখন নিহত ফুলগাজী চেয়ারম্যানের ‘সমর্থক’ শিপলু হামলা চালানোর সময় তার নিজের নিবন্ধিত একটি শটগান দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন তখন একরাম নিজেও তার নিবন্ধিত ৭.৬২ এমএম পিস্তলটি দিয়ে একবার গুলি করেছিলেন।
সিআইডি ইন্সপেক্টর ইব্রাহিম বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরে পুরো ঘটনাস্থলই অপরাধীরা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলায় প্রমাণ খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, একরামের দেহের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. প্রদীপ কুমার নাথ জানান, যে গুলিটি একরামের দেহে বিদ্ধ হয়েছিল সেটি তার দেহ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে এবং সেটা উদ্ধারও করা যায়নি। ফলে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় দুবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ৪৭ বছর বয়স্ক একরামুল হককে ফেনী জেলা সদরের একাডেমি এলাকায় প্রথমে গুলি করে এবং পরে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।