শেষ হাসি কে হাসবে
সুরমা টাইমস ইন্টারন্যাশনালঃ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা ভারতের লোকসভা ভোটযুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। আট দফায় লোকসভার ৫০২ আসনের ভোট শেষ হয়েছে। বাকি মাত্র ৪১ আসনের ভোট ১২ মে অনুষ্ঠিত হবে। ১৬ মে জানা যাবে শেষ হাসি কারা হাসছেন।
১২ মে যে রাজ্যগুলোতে ভোট হচ্ছে সেগুলো হলোÑ উত্তর প্রদেশে ১৮, বিহারে ৬, পশ্চিমবঙ্গে ১৭ আসন। ক্ষমতায় যেতে হলে এই ৪১টি আসনের অধিকাংশই বিজেপিকে কব্জা করতে হবে। উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র চারটি আসন। কংগ্রেস ও বহুজন সমাজ পার্টি পেয়েছিল ১০টি করে।
চার মাস আগে বিজেপির নানা টালবাহানার পর আদর্শিক মিত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সিদ্ধান্তের কাছে মাথানত করে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। একটা সময়ে বিজেপি নয়, ভোট প্রচারের কেন্দ্রে চলে আসেন মোদি নিজেই। মোদি সেবক সংঘ ও দলকে ছাপিয়ে ক্রমে লড়াইটা ব্যক্তি বনাম সমষ্টিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। এখন সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন কিংবা আউটডোর পাবলিসিটি যেখানেই চোখ যায়, সর্বত্র একটাই স্লোগান, ‘এবার মোদি সরকার।’ প্রচারে মোদি ও দলীয় প্রতীক পদ্মফুল ছাড়া আর কারও উপস্থিতি সেভাবে চোখে পড়ে না।
তবে শুরুতে পরিস্থিতি যা ছিল এখন কিন্তু আর সে রকম নেই।
মোদির বারানসি থেকে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যই ছিল পূর্বাঞ্চলে আসন বাড়ানো এবং তার প্রভাব বিহারে ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই বারানসিতেই মোদিকে জনসভা করতে অনুমতি দেয়নি নির্বাচন কমিশন।
বারানসির বীনাবাগ এলাকায় জনসভার অনুমতি চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এই কারণ দেখিয়ে অনুমতি দেননি রিটার্নিং অফিসার প্রাঞ্জল যাদব।
প্রতিবাদে ওই রিটার্নিং অফিসারের অপসারণ দাবি করেছে বিজেপি। বারানসি এবং দিল্লিতে বিক্ষোভ করেছে দলটি। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন অরুণ জেটলি ও অমিত শাহর মতো বিজেপির প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ।
এদিকে এই বিতর্কে মুখ খুললেন বারানসি কেন্দ্রে মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আপ প্রধান বলেন, গঙ্গায় আরতির জন্য অনুমতি লাগে না।
এদিকে শেষবেলায় ভোট প্রচারে মোদি দুটি কৌশল নিয়েছেন। নিজের জাতিগত অনগ্রসর সত্তা ও চা বিক্রির অতীত পেশাকে বড় করে তুলে ধরে ‘নিম্নবর্গীয় মানসিকতায়’ নাড়া দিতে চেয়েছেন।
রাহুলের নির্বাচন কেন্দ্র আমেথিতে ভোট প্রচারে গিয়ে রাজীব গান্ধীসহ গোটা গান্ধী পরিবারকে মোদি আক্রমণ করে বলেছিলেন, ৪০ বছরেও গান্ধী পরিবার আমেথির কোনো উন্নয়ন করেনি।
এর উত্তরে রাজীব কন্যা প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘আমেথির মানুষ বুথে গিয়ে এই হীন রাজনীতির জবাব দেবেন।’
প্রিয়াঙ্কার কথার সূত্র ধরে মোদি পর দিনই জাতপাতের রাজনীতি উস্কে দেন। ট্যুইট করে বলেন, ‘আমি নি¤œ জাতি থেকে এসেছি বলেই আমার রাজনীতি ওদের নি¤œ মনে হয়।’
প্রিয়াঙ্কা বলেছিলেন রাজনীতির নি¤œমানের কথা। কিন্তু সেই কথাকেই জাতপাতের রং লাগিয়ে ভোট-বাজারে ছেড়ে দেন মোদি।
বারানসি থেকে প্রার্থী হয়ে পূর্ব উত্তরপ্রদেশে এমনিতেই মেরুকরণের রাজনীতি উস্কে দিয়েছেন মোদি। তার লক্ষ্য বারানসি ও সংলগ্ন পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও লাগোয়া বিহারে উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটারদের বিজেপির পক্ষে সংহত করা। পূর্ব উত্তরপ্রদেশে এই মুহূর্তে বিজেপির মাত্র দুটি আসন বারানসি ও গোরক্ষপুর। বাকি আসনগুলোতে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টির যথেষ্ট প্রভাব ছিল এতদিন। এবার উচ্চ বর্ণের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও ওবিসির ভোট পেতেও মরিয়া বিজেপি। তাই তিনি নি¤œ জাতের প্রসঙ্গ উস্কে দিয়েছেন।
মোদির জাতপাত বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘জাত কখনও নি¤œ হয় না। কারো কারো মানসিকতা নি¤œ হয়।’
কংগ্রেসের মুখপাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শশী থারুর বলেন, কংগ্রেসের কোনো নেতা কোনোদিন দলিতদের নি¤œ জাতি বলে মন্তব্য করেননি। বরাবর বলেছে পিছিয়ে পড়া জাতি। তারা সামাজিক ও আর্থিকভাবে অনগ্রসর। কিন্তু সেই অনগ্রসরতার কারণে কারও মর্যাদা খাটো হয় না। অথচ নি¤œ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে দলিতের মর্যাদাকেও এখন খাটো করছেন মোদি।
লড়াই শুরুর আগে বিজেপির নজরে ছিল উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মোট ১২০টি আসনের মধ্যে অন্তত ৬০টি। এনডিটিভির সর্বশেষ জরিপে শুধু উত্তরপ্রদেশ থেকেই দলটিকে ৫৩টি আসন দেওয়া হয়েছে!
তবে আগেই বলেছি, পরিস্থিতি এখন আগের মতো নেই। ভোটের আগে পরিচালিত জরিপগুলোতে বিজিপের একক আধিপত্য থাকলেও এখন বাস্তবতা ভিন্ন। মোদি এবং তার দলের বিতর্কিত মন্তব্য দলটি অনেকটাই কোণঠাসা। এছাড়া নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রদায়িকতার খোলস ছেড়ে এখনো বেরুতে পারেনি এটি তার সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যেই স্পষ্ট হচ্ছে।
এছাড়া নির্বাচনী প্রচারে মোদির অন্যতম প্রধান অস্ত্র গুজরাট মডেলও ফলপ্রসূ হচ্ছে না। গুজরাট সরকারের সাফল্য সম্পর্কে যে ফানুস ওড়ানো হয়েছে তা যে সঠিক নয়, অর্থনীতিবিদদের একাংশ স্পষ্ট করেই তা জানিয়েছেন।
শুরুতে কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে ১০০ পেরোতে পারবে না বলে একটা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে দলের অনেক বড় নেতা নির্বাচনে অংশ নিতেই ভয় পেয়েছেন।
তবে এটা ঠিক যে, প্রথম দিকে কংগ্রেস সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল মিডিয়ার বদৌলতে তা অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে কংগ্রেস ১০০ পেরিয়ে যাবে অনায়াসেই। গত নির্বাচনে এই কংগ্রেসই পেয়েছিল ২০৬ আসন।
ফলে কংগ্রেসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত ধরে নিয়েই ভারতের সব কটি দল তাদের ঘুঁটি সাজিয়েছেন। পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অনেক আঞ্চলিক দল নির্ণয়কের ভূমিকা নেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ তালিকায় তামিলনাডুর এআইডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়েক বা নীতিশ কুমারের মতো নেতারা। ফলে এবারের নির্বাচনী লড়াই হচ্ছে বহুমুখী।
বিজেপির প্রভাব প্রতিপত্তি সবই উত্তর ও পশ্চিমনির্ভর। সারা দেশে বিজেপির প্রভাব বিন্যস্ত নয়। ফলে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি যাওয়া তাদের পক্ষে খুবই কঠিন। অবশ্য মোদির নামে যদি কোনো ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয় তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। যদিও মোদি হাওয়া অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে এসেছে। তাই সরকার গঠনের জন্য ২৭২ আসনের ম্যাজিক নম্বরে পৌঁছতে হলে বিজেপিকেও জটিল অঙ্কের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে হবে।