এক সঙ্গে ছয় মেয়ের বিয়ে!
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিশাল আয়োজন। বর্ণিল আলোকসজ্জা। দেখে মনে হয় রাজসিক কোনো আয়োজন। আসলে তা নয় । তবে এর চেয়ে কমও বলা যায় না। একসঙ্গে ছয় মেয়ের বিয়ে! চাট্টিখানি কথা নয়। নাকফুল, গয়না, শাড়ি, জুতা, হাতের ব্যাগ থেকে শুরু করে সবকিছুই কিনতে হয়েছে ছয়টি করে। বরদের জন্য শেরোয়ানি, পায়জামাসহ যা কিছু লেগেছে, তা-ও কেনা হয়েছে ছয়টি।
এ বিয়েতে কনেদের অভিভাবক সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাছিমা বেগম, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেশকাত আহমেদ চৌধুরী, ঢাকার জেলা প্রশাসক শেখ ইউসুফ হারুনসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বর-কনেকে দোয়া করেন, বিভিন্ন উপহার দেন। বর-কনের সঙ্গে এক মঞ্চে ছবিও তোলেন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এভাবেই ঘটা করে তেজগাঁও সরকারি শিশু পরিবারের ছয় মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত এ শিশু পরিবারেই তাঁরা ছোট থেকে বড় হয়েছেন। তাঁরা সবাই এতিম। কারোই বাবা নেই। মা থাকলেও তাঁদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এই সমাজে একটি মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার সামর্থ্য নেই। ঘটা করে বিয়ে দেওয়া তো স্বপ্নের মতো। সেই মেয়েদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিয়ে করতে পারায় বর ও বরপক্ষের লোকজন নিজেরাও সম্মানিত বোধ করছিলেন।
ফুল, লাল ও ঘিয়ে রংয়ের কাপড় দিয়ে দিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়। মঞ্চে বউ ও বর সেজে বসেন হেলেনা-সোলাইমান খান, ডলি-শাহাদাত হোসাইন, লিজা-রনক মিয়া, আসমা-উজ্জ্বল সরকার, মর্জিনা-আফজাল মণ্ডল ও মনোয়ারা-সাইফুল ইসলাম। বিয়েতে কনেদের মায়েরাও উপস্থিত ছিলেন।
একেক মেয়ের গায়ে তিন ভরি করে গোল্ড প্লেটেট রুপার গয়না। নাকে স্বর্ণের নাকফুল। সমাজসেবা অধিদপ্তরের শহর উন্নয়ন প্রকল্পের (আজিমপুর) বিউটি পারলারের প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রতিনিধিরা কনেদের সাজিয়েছেন। একজন মা বলেই ফেললেন, ‘এইখানে না থাকলে মেয়েকে এভাবে বিয়ে দিতে পারতাম না।’
শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক ঝর্না জাহিন এই পরিবারের শিশুদের মা। ফলে তাঁর দম ফেলারও ফুরসত নেই। কাজের ফাঁকেই এক মেয়েকে খানিকটা বকা দিয়েই বললেন, ‘কাল গায়েহলুদের সময়ও তুমি কুঁজো হয়ে বসেছ। আজও তা করছ। দেখতে ভালো লাগছে না। সোজা হয়ে বসো।’
পাঁচ মাস আগে এই মেয়েদের কাবিন হয়েছে। আজ ছিল ঘটা করে মেয়েদের স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া। দুপুর দুইটা ২০ মিনিটে ছয় বর ও বরযাত্রীরা এলেন। শিশু পরিবারের ছোট মেয়েদের বেশ কয়েকজন নীল ও সাদা রংয়ের ফ্রক পরে গেটে ফুল নিয়ে দাঁড়ানো। ছয় বর আসার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ছিটানোসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার পালা শুরু হয়।
ঝর্না জাহিন বলেন, ‘কেউ যেন বলতে না পারে এতিম বলে যেনতেনভাবে ওদের বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। তাই কেনাকাটাসহ সবকিছু যাতে নিখুঁত হয়, তা দেখা হয়েছে। স্বর্ণ দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য শিশু পরিবারের নেই। তার পরও বিয়েতে একটুও স্বর্ণের গয়না থাকবে না, তা তো হয় না। তাই সবার নাকফুল স্বর্ণের।’
এই পরিবারের আগে বিয়ে হওয়া চার মেয়ে ও মেয়েজামাই বিয়েতে আসেন। একজন তিন মাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে হাজির হন। তাঁরা বিয়ের বিভিন্ন বিষয়ে তদারকি করেন।
খাবারের আয়োজনের মধ্যে ছিল পোলাও, রোস্ট, রেজালা, সবজি, বোরহানি, জর্দা। খাবার টেবিলগুলোতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিজেরা তদারকি করছিলেন। বিশেষ করে বরপক্ষ যেসব টেবিলে বসেছেন সেখানে যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে।
শিশু পরিবারে এই ছয় মেয়েসহ বিভিন্ন বয়সী মোট মেয়ের সংখ্যা ১৭৫ জন। ছোট মেয়েরা বড় বোনদের বিয়েতে নতুন জামা পরেছে। বড় আপা ও দুলাভাইদের সঙ্গে ছবি তুলছে। বিয়ের কনেদের চোখেমুখে নতুন জীবনের স্বপ্ন। একই সঙ্গে পরিবারের এই ছোট বোন, মা ও অন্যদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে চোখ ছিল ছলছল।
ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বলেন, এই মেয়েদের বিয়ের জন্য আলাদা কোনো বাজেট নেই। প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ তহবিল ও বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের অনুদান দিয়েই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে এই মেয়েদের জন্য খরচ করার বিষয়টিকে ভালো কাজ হিসেবেই দেখেন।
বর সাইফুল ইসলামের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এতিমদের সহযোগিতা করা সবার কর্তব্য। তাই এই মেয়েকে ছেলের বউ করেছি। বিয়েতে কোনো দাবিদাওয়াও (যৌতুক) করি নাই।’
এই পরিবারের যে মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে তাঁরা সবাই ভালো আছে কি না, জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেশকাত আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বিয়ের পরও এই মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়। কোনো সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আর এই মেয়েদের সঙ্গে বরপক্ষ খারাপ ব্যবহার করতেও খানিকটা ভয় পায়। কেননা তারা জানে, তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করা হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’