নির্দলীয় সরকারের দাবি জোরালো করলো আ.লীগ!

voteসুরমা টাইমস রিপোর্টঃ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের শেষ বছরে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যায় সরকার সমর্থকরা। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের দুই বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বড় ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও তিনবারের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেও একই পরিণতি ভোগ করে সরকার সমর্থকরা। কিন্তু এসব পরাজয়ে সরকারের তেমন লোকসান হয়নি। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব-বিষয়টি জোর গলায় বলতে পেরেছে আওয়ামী লীগ।
তবে এবার উপজেলা নির্বাচনে বিশেষ করে বরিশাল, ভোলা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনীর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে নানা ঘটনার জন্য উঠছে আবার ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না’ সেই প্রশ্ন। এসব উপজেলায় কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, ভোটারদের আসতে বাধা দেওয়া, অন্য দলের প্রার্থীর এজেন্টদেরকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর বেশ কিছু উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তুলনায় বিজয়ীর ভোটের ব্যবধান এতো বেশি ছিল যে, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্বের উপজেলা নির্বাচনের ভোট নিয়ে অবশ্য তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। দুই একটি এলাকায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা গোটা নির্বাচনী পরিবেশকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারেনি। আর বিএনপি সমর্থিতরা যেখানে ৩৯টি উপজেলায় জিতেন চেয়ারম্যান পদে, সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা জিতেন ৩৪টিতে। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি না হলেও সরকার সমর্থিতদের তুলনায় বিএনপি সমর্থিতদের বেশি জেতা নিয়ে চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয় দফা ২৭ ফেব্রুয়ারির ভোটেও ঘটে একই ঘটনা। এই পর্বে বিএনপি সমর্থিতরা চেয়ারম্যান পদে জিতে ৫০ উপজেলায় আর আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা জিতে ৪৪টিতে। এই ভোট নিয়েও ওঠেনি তেমন কোনো অভিযোগ।
তবে ১৫ মার্চ তৃতীয় দফা এবং ২৩ মার্চ চতুর্থ দফা ভোটে সরকার সমর্থিতরা বিএনপি সমর্থিতদের তুলনায় ভালো করেছেন বেশি। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ভালো করলেও সরকারের ওপর তৈরি হয় চাপ। এই দুই পর্বে বিভিন্ন উপজেলায় ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠে। আর এর পরই বিএনপি নেতারা বলতে থাকেন যে, তাদের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি যুক্তিযুক্ত, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি তা দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায়। আওয়ামী লীগ তখন বলেছিল, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে ভোটে কারচুপির কোনো আশঙ্কা নেই, বিএনপির ভোট বর্জন অযৌক্তিক।
চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচনের ভোটের পর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোও। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের মূল্যায়ন হচ্ছে নির্বাচনে কর্তৃত্ব হারিয়েছে নির্বাচন কমিশন, সরকার সমর্থিতরাই বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে কর্তৃত্ব করছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই পুরনো ভোট জালিয়াতি ও শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। প্রশাসনের পাহারায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালট ছিনতাই করছেন, বুথ দখল করে সিল মারছেন-এমন খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটি নতুন নয়। আমরা আগে থেকেই বলে আসছিলাম দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। উপজেলা নির্বাচনে যেখানে সরকার সমর্থিতরা প্রভাব বিস্তার করছে সেখানে জাতীয় নির্বাচনে চুপ করে বসে থাকতো তা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
তবে বিএনপির এই দাবিকে অসত্য মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির কথা হচ্ছে, জিতলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, না জিতলে কারচুপি হয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতো তবে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন তো আর জিততে পারতো না। নির্বাচন মানেই হারজিত। এটা তাদের মানতে হবে।’
ক্ষমতাসীনদের জোর জবরদস্তি, নির্লিপ্ত নির্বাচন কমিশন
তৃতীয় ও চতুর্থ দফা ভোটে ৩০টিরও বেশি উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও ভোট কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এসব ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ছিল প্রায় নির্লিপ্ত। বরং ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, ‘আমরা খুব চেষ্টা করেছি যেন কোথাও সহিংসতার ঘটনা না ঘটে। এরপরও কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তাই বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এটা বলা যাবে না।’
হঠাৎ ক্লান্ত সিইসির বিদেশে ‘বিশ্রাম’
উপজেলা নির্বাচন চলাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সিইসির এমন ছুটিতে বিস্মিত হয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। বিএনপিও প্রশ্ন তুলেছে এ নিয়ে। সরকারি দলের চাপের মুখে তিনি অভিমান করে এই ছুটি নিয়েছেন বলেও কথা ছড়ানো হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বনিবনা হচ্ছিলো না সিইসির। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। শেষমেশ সিইসি ‘ছুটি’ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। তিনি আদৌ কবে কী ফিরবেন বা ফিরবেন কি না সে নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তাছাড়া সিইসি দেশ ছাড়ার পর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সিইসি ক্লান্ত। তিনি বিশ্রামে গেছেন।’ এ বক্তব্যেও জনমনে সন্দেহের দানা বেঁধেছে।
বিএনপির দাবি, নির্বাচন কমিশন যে দায়িত্বজ্ঞানহীন তারই প্রমাণ এ মুহূর্তে সিইসির দেশত্যাগ। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। তা না হলে দায়িত্ব এড়াতে সিইসি কখনোই নির্বাচন রেখে বিদেশ যেতে পারতেন না।’
কী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই সময়কে বলেন, ‘নির্বাচন মানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু যেভাবে ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে তাতে জনগণের সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ সম্ভব হবে না। এতে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই পুরনো ভোট জালিয়াতি ও শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। প্রশাসনের পাহারায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালট ছিনতাই করছেন, বুথ দখল করে সিল মারছেন-এমন খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।’
দুই পক্ষের বক্তব্যই ঢালাও
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু এখন যখন ভোটে তারা আওয়ামী লীগের প্রতি অনাস্থার জানান দিচ্ছে তখনই বাঁধছে বিপত্তি। নিজেদের নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচাতে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে। আর এসব অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
প্রথম পর্বে মোটামুটি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হলেও বিএনপি দিনভর ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ তোলে। দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ভোট চলাকালে প্রতি ঘণ্টায় সংবাদ সম্মেলন করে বিভিন্ন উপজেলায় ভোট কেন্দ্র দখল করে নেওয়ার অভিযোগ করেন। এ কারণে বিএনপি সমর্থিতরা ১০টি উপজেলায় কারচুপির অভিযোগে পরদিন হরতালও ডাকেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনটিতে জিতে চায় বিএনপি সমর্থিতরা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেন, যেন কারচুপি না হয় সে জন্য আগেভাগে তারা অভিযোগ করে রেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগ অবশ্য ভোটে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ স্বীকার করতে চায় না। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ কারচুপি করলে জামায়াত সমর্থিতরা এতোগুলো উপজেলায় জিততে পারতো না।
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, দলের মধ্যে ঐক্য থাকলে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা আরও ভালো করতো। তিনি বলেন, ‘অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা হেরেছেন একাধিক প্রার্থী থাকায়। বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে না যাওয়ায় ভোট ভাগ হয়ে গেছে। এর সুযোগ নিয়েছে প্রতিপক্ষ।’