মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রতারণা: ইরানে বাংলাদেশী দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন ২৬ জন
লোভ দেখানো হয়েছে বড় অঙ্কের বেতনের। ইতালি, গ্রিস, ইরাক ও লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নেয়া হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কিন্তু ইরান সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। ফাঁদে পা দিয়ে বন্দি হয়েছেন প্রতারক চক্রের হাতে। শেষমেশ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তাদের কেউ কেউ। আবার কেউ মুক্তিপণ দিতে না পেরে আটক থেকে শিকার হন অমানুষিক নির্যাতনের। দালালদের মাধ্যমে তাদের কেনাবেচা হয় সেখানে। হাতবদল হওয়ার পর আবার মুক্তিপণ দিতে হয়। অবশেষে যারা ছাড়া পান তারা দেশে ফিরতে পারেন না। আশ্রয় নেন বাংলাদেশী দূতাবাসে।
এ মুহূর্তে ইরান দূতাবাসের আশ্রয়ে আছেন এরকমই ২৬ জন। এর আগে একই ভাবে বন্দিদশা শেষে দেশে ফেরেন ৪৬ জন। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে তাদের রেখে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয় বলে আটকরা কোন তথ্যই দিতে পারেন না। ফলে তাদের অভিযোগের পর দূতাবাসে পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না ইরানের পুলিশ।
সমপ্রতি পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সীমান্ত ট্রাফিকিং-এর শিকার বাংলাদেশী প্রবাসীদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি বেসরকারি সংস্থা ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম- শিসুক’ থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি তারা লিখিত জানিয়ে কিভাবে প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে তার একটি চিত্র তুলে ধরেন। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই দফায় আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশী এই ২৬ নাগরিক। প্রথম দফায় ৯ জন ও পরের ১৭ জন এসে দূতাবাসে আশ্রয় নেন। তারা প্রতারক চক্রের খপ্পরে ২ থেকে ৩ মাস বন্দি থেকে অসহনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন করেছেন। এদিকে তারা দূতাবাসকে এরকম আরও বন্দি ইরানের বন্দরে আব্বাসে আছেন বলে জানান। দূতাবাস ইরান কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছে।
আলাপকালে সংস্থার কর্মকর্তা ও সেখানে প্রতারণার শিকার হয়ে আসা শ্রমিকরা জানান, দুবাই, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ইতালি, কাউকে গ্রীস প্রভৃতি দেশে পাঠানোর নামে টার্গেট করা হয় বাংলাদেশী শ্রমিকদের। এর সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রবাসে যারা একটু খারাপ অবস্থা পার করছেন তাদেরই টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়। দালালদের মাধ্যমে এটা করা হয়। ভাল বেতনে চাকরি, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির কথা বলে তাদের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়। ইরানের বন্দর আব্বাস দিয়ে সমুদ্র পার করে ইরানে প্রবেশ করানো হয়। সেখানে নেয়ার পরই তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বন্দি করা হয়। প্রথমে খেতে না দিয়ে, শারীরিক ভাবে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। জীবনের মায়া থাকলে তাদের কথা শুনতে বলা হয়।
শিসুকে’র প্রকল্প কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন বলেন, তারপর তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের টেলিফোন নম্বর। বাংলাদেশ থেকেই যোগাযোগ করা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এখানে থাকা দালাল ও প্রতারক চক্রের সদস্যরাই মুক্তিপণ আদায় করে। টাকা নেয়া হয় বিকাশ ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। কেউ কেউ ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমেও টাকা নেয়। স্বজনের জীবন ঝুঁকিতে থাকায় কেউ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের কানে সেই খবর দেন না। এর সঙ্গে বড় একটি প্রভাবশালী চক্র জড়িত দাবি করে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে যারা মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি কাজে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর লোকজন প্রতারণার এই ফাঁদ ফেলার সঙ্গে জড়িত।
এদিকে মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা ছাড়া পেলেও দেশে ফিরতে পারেন না। তাদের ছেড়ে দেয়া হয় দূতাবাসের আশপাশে। সেখান থেকে তারা আশ্রয় নেন দূতাবাসে। তারা জানান, এটি এখন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বুঝতে না পেরে অনেক সহজ সরল শ্রমিক ভাগ্য পাল্টানোর আশায় পা দিচ্ছেন তাদের পাতানো ফাঁদে। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের আন্দারমানিক গ্রামের ইলিয়াস গত বছরের অক্টোবরে দেশে ফিরেছেন। তিনি জানান, তাকে এর জন্য মুক্তিপণ হিসেবে ৫ লাখ ১০,০০০ টাকা দিতে হয়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও এসএ পরিবহনের মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্যরা এই টাকা পরিশোধ করেন। তিনি বলেন, সীমান্ত থেকে কালো গ্লাসের জিপে করে তাদের ১৯ জনকে নেয়া হয় ইরানে। প্রথমে জঙ্গলে রাখা হয়। পরে একটি বড় ঘরে। চোখ বাঁধা থাকতো বেশির ভাগ সময়। তাদের এক দফা বিক্রিও করা হয় অন্য পার্টির কাছে। এ জন্য প্রত্যেকের মূল্য ধরা হয় ৫০,০০০ টাকা। তিনি জানান, তারা ঘরের এসি ভেঙে সেই পথ দিয়ে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। পরে বিচারের মুখোমুখি হয়ে দেশে ফেরেন। তিনি জানান, তার মতো অনেকেই ছিলেন সেখানে। সরকারকে এ নিয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। – মানবজমিন