এখন নির্বাচন নেই; তাই অছাত্ররাও নেতা হচ্ছেন
মো. বদরুজ্জামান সেলিম। সিলেট মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘ ৩৮ বছর থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এককালে ছিলেন সিলেট ছাত্রদলের সভাপতি। নগরীর শাহী ঈদগাহর ৫১ হাজারিবাগ আবাসিক এলাকার নীরু মঞ্জিলের বাসিন্দা নগরীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম জহির উদ্দিন তারু মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে সিলেটে যাদের সুনাম রয়েছে, তিনি তাদের একজন। সম্প্রতি তিনি তাঁর নিজ বাসায় মুখোমুখি হন দৈনিক সবুজ সিলেটের ‘আয়না’র।
শিক্ষা, সংসার, রাজনীতি এবং সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন বদরুজ্জামান সেলিম। গল্পের ফাঁকে ওঠে আসে কীভাবে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও দলের চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া তাঁর কাছে সম্মানীয় হয়ে আছেন। কীভাবে তাদেরকে ভালোবেসে বিএনপির আদর্শ ধারণ ও লালন করছেন রাজনৈতিক জীবনে। কথা বলেছেন, সিলেটের রাজনীতির জানা-অজানা অনেক বিষয়ে। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল হক শিপু।
শিক্ষাজীবন এবং শিক্ষার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, পারিবারিকভাবেই শিক্ষাজীবনে প্রবেশ। মা-বাবার অনুপ্রেরণায় ১৯৮১ সালে দি এইডেড মাল্টি লেটারেল হাইস্কুলে থেকে এসএসসি, ১৯৮৩ সালে সিলেট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৮৫ সালে এমসি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৮৭ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নগরের দি এইডেড মাল্টি লেটারেল হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও দলের আদর্শ ভালোবেসে তিনি রাজনীতিতে আসেন। ১৯৭৮ সালে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে ফরম পূরণের মাধ্যমে নিজ এলাকা শাহী ঈদগাহে শহীদ জিয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সিলেট সরকারি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে একই কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল (আরিফ-সেলিম) পরিষদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় এরশাদ সরকারের সামরিক শাসন জারির কারণে নির্বাচন ব্যাহত হয়। ১৯৮৩ সালে এমসি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি, ১৯৮৫ সালে সিলেট আইন মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদল শাখার আহবায়ক, ১৯৮৮ সালে সিলেট জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক এবং ১৯৮৯ সালে এবং ১৯৯১ সালে বিএনপি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতাদের উপস্থিতিতে টানা দুবার সিলেট জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তাঁর উদ্যোগে যুক্তরাজ্য ছাত্রদলের প্রথম সম্মেলনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সম্মেলনে ছাত্রদলের তৎকালীন আহ্বায়ক ডাকসুর ভিপি আমান উল্লাহ আমান ও কমিটির সদস্য ইলিয়াছ আলীসহ তিনি নিজে যুক্তরাজ্য সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম লন্ডন সফরকালীন দলীয় বিভিন্ন কর্মর্সূচি আয়োজনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৩ সালে সংগঠনের কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ছাত্রদলের সমন্বয়কারী দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেট অঞ্চলের ৪টি জেলায় ছাত্রদলকে সুসংগঠিত করার কাজে সফল হন। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিএনপি ও ছাত্রদলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনসহ তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেন। একই বছর নিউইয়র্কে সাংগঠনিক সফরকালে কেন্দ্রীয় বিএনপি মো. বদরুজ্জামান সেলিমকে সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে কেন্দ্রীয় বিএনপি নির্দেশ দেয়। তিনি দেশে ফিরে নির্বাচন করেন। তবে জয়ী হতে পারেননি। ১৯৯৫ এবং ১৯৯৭ সালে তিনি টানা দুবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯৮ সালে বদরুজ্জামান সেলিম সিলেট জেলা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ১৯৯৯ সালে সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক, ২০০২ সালে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ২০০৫ সালে সিলেট মহানগর বিএনপির সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। পরে বিএনপি নেতা সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান ঘোষিত কমিটিতে সহসভাপতি, ২০০৯ সালে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ২০১০ সালে মহানগর বিএনপির সহসভাপতি, ২০১৪ সালে কেন্দ্রঘোষিত মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য সচিব এবং সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মহানগর বিএনপির কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট ইউনিটের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বেসরকারি কারাগার পরিদর্শক, সিলেট নজরুল একাডেমীর সভাপতি এবং জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিজের পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, তাঁরা ৬ ভাই। সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই মরহুম আক্তরুজ্জামান শরিফ ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। বদরুজ্জামান সেলিম দ্বিতীয়। তিনি ৩৮ বছর থেকে করছেন বিএনপির রাজনীতি। বাকি চার ভাইও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত আছেন। তৃতীয় ভাই সামসুজ্জামান শওকত একজন ব্যবসায়ী ও বিএনপি সমর্থক। চতুর্থ ভাই কামরুজ্জামান শামীম যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা, পঞ্চম ভাই অ্যাডভোকেট নাসিরুজ্জামান নাজিম বিএনপি নেতা এবং সব ছোটভাই আহসানুজ্জামান আরিফ সিলেট মহানগর জাসাসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুক্তরাজ্য বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্য বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়।
বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়া প্রসঙ্গে এককালে তুখোড় এ ছাত্রনেতা বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা না থাকা। বর্তমানে যারা ছাত্ররাজনীতি করছেন তাদের দেশের প্রতি এবং সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা কম। যার ফলে তাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়ার বড় কারণ হিসেবে তিনি মনে করছেন, ছাত্রসংসদ নির্বাচন বিলীন হয়ে যাওয়া। বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, আমাদের সময় নেতৃত্বে আসতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে বিজয়ী হওয়ার পর পদ পেতাম। এখন নির্বাচন নেই; তাই অছাত্ররাও নেতা হচ্ছেন। যার কারণে তারা পদের মূল্য দিতে পারছে না। নেতৃত্ব জাহির করতে নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে তারা নিজেরাই রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ছে। দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে; অভিযুক্ত হচ্ছে। যার কারণে তারা ভবিষ্যতে অভিভাবক সংগঠনের দায়িত্বে আসতে পারছে না। তিনি বলেন, সঠিক ধারা ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হলে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত ছাত্ররা নেতৃত্বে এলে ভবিষ্যতে যোগ্য ও শিক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। যারা আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে সামন থেকে-এ আমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, এখনও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ছাত্রসংগঠনের কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব সৃষ্টি করছে। যদিও তারা সংখ্যায় কম, তারপরও তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আছে।
আগামীতে গণপ্রতিনিধি বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার আশা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতির পূর্বশর্ত হচ্ছে জনগণের সেবা করা। তাই একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার মূল লক্ষ্য মানব সেবা করা। আর মানুষের একদম পাশে থেকে সেবা করার সুযোগ পান গণপ্রতিনিধিরা। আমার দল যখন আমাকে মূল্যায়ন করবে, আমি তখনই নির্বাচনের মাঠে নামব। নির্বাচিত হলে জনগনের পাশে থেকে সেবা করার পাশাপাশি উন্নয়ন কাজও করে যাব। জনসেবাকে এবাদত হিসেবেই নিতে চাই। তবে কোনো দিন নির্বাচনের সুযোগ এলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অথবা সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। কারণ আমি আগে পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে অংশ নেই। তাই কাউন্সিলর পর্যায়ের নির্বাচন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জীবনের সবচেয়ে বেদনার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতি করলে সুখ-দুঃখকে সঙ্গী করেই করতে হয়। তবে সবচেয়ে বেদনা দেয় ৩৮ বছরে অকারণে অর্ধশতাধিক মামলায় জর্জরিত হয়েছি। ২০০৬ সালে ১/১১-এর জরুরি অবস্থায় আমার উপর অকারণে ৪টি মামলা দেওয়া হয়। এ সময় নিজেকে রক্ষা করতে কিছুদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে অকারণে সাড়ে চার মাস কারাভোগ করি। এখনও ১১টি মামলায় প্রতিনিয়ত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে আমাকে। তিনি বলেন, এলএলবি সম্পন্ন করলেও এরশাদ সরকারের সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে আমি সনদ নিতে পারিনি। এ বিষয়টি আজও আমাকে ব্যথিত করে।
আগামী বাংলাদেশ কেমন চাচ্ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশে যে সর্বদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; সেই গণতন্ত্রকে বর্তমান সরকার গলা টিপে হত্যা করেছে। মানুষ শান্তিতে নেই। দেশ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তাই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে আগামীর বাংলাদেশ একটি সুন্দর, শান্তিপ্রিয় এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
জনশ্রুতি রয়েছে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদলের ব্যানারে আপনিই বিএনপির কার্যক্রম ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু আপনার দল আপনাকে অনেক পর মূল্যালয়ন করল-এ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, দলের হাইকমান্ড আমাকে সব সময় মূল্যায়ন করেছে। আজও করছে। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন পরে মূল্যায়ন পাওয়ার কারণ দলের ভেতরের একটি কুচক্রী মহল রয়েছে। যারা আসলেও দলের ভালো চায় না। তাদের কারণেই আমি পেছনে ছিলাম। তবে কেন্দ্র সব সময় আমার সঙ্গে ছিল। হাইকমান্ড সর্বশেষ আমাকে ২০১৪ সালে মহানগরের সদস্য সচিব দিয়েছে। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীরও সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাজ্য গেছি। ১৯৯৪ সালে দল আমাকে পৌরসভার নির্বাচন করতে নির্দেশ দিয়েছে। এটি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তিনি বলেন, আমি সব সময় দলের জন্যই নিবেদিত। ৩৮টি বছর কাটিয়ে দিয়েছি জিয়াউর রহমান এবং বেগম জিয়ার আদর্শ ধারণ ও লালন করে। এ যাত্রা মৃত্যুর আগ পর্যন্তই অব্যাহত থাকবে।
বদরুজ্জামান সেলিম ৩ ছেলে সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী শামিমজ্জামান হেনা একজন শিক্ষিকা। তিনি আনন্দ নিকেতন স্কুলের ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি বদরুজ্জামান সেলিম বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।