অনৈক্যের গ্যাড়াকলে সিলেটের শতাধিক মহিলা মাদ্রাসা
স্টাফ রির্পোটার : সিলেটের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে শতাধিক মহিলা মাদ্রাসা। সমন্বয়হীন তিনটি মহিলা মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এগুলো। বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিরা এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাদের মত পার্থক্যের (এখতেলাফ) কারণে অনৈক্যের গ্যাড়াকলে আছে মহিলা মাদ্রাসাগুলো। ভিন্ন সিলেবাসে,ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে একই কোর্স সম্পন্ন হচ্ছে মাদ্রসাগুলোতে। অথচ সবাই চান ঐক্য। কিন্তু কে টেনে ধরবে ঐক্যের সুতো ? এমনি প্রশ্ন সবার মুখে। এ মাদরাসাগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট ধারণা । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সবারই উদ্দেশ্য এক। সবাই চান মহিলাদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। অবশ্য শিক্ষার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের ধান্ধায়ও এরকম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন কেউ কেউ। সুরমাটাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমনি কিছু তথ্য।
খাদিজা ইসলামিয়া মহিলা (টাইটেল) মাদরাসা: মহিলা মাদরাসাগুলোর মধ্যে তের রতন মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে শেখঘাট ভাঙ্গাটিকরপাড়া মসজিদ সংলগ্ন খাদিজা ইসলামিয়া মহিলা (টাইটেল) মাদ্রাসা। মাদরাসা প্রধান রোকেয়া বেগম জানান ু২০০১ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বামী আলহাজ আব্দুল হক যাদু। তিনি জানান,মাদ্রাসাটি তার বাসার একাংশে ছয় ডিসিমেল জায়গার উপর নির্মিত। ছাত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বেতন ও প্রবাসী আতœীয় স্বজনদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে মাদরাসাটি পরিচালিত হয়। তবে অধিকাংশ ছাত্রী গরিব হওয়ায় নিয়মিত বেতন পাওয়া যায় না। এখানে শিশু শ্রেণী থেকে দাওরা (টাইটেল) পর্য পড়ানো হয়। মাদরাসার ছাত্রী সংখ্যা ১৬০ জন। এর মধ্যে ৮০ জন ছাত্রী মাদরাসাতেই থাকেন। ১২ জন মহিলা শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক অছেন ১৭ জন। পুরুষ শিক্ষকরা পর্দার আড়ালে থেকে ছাত্রীদের ক্লাস নেন। এখানে দ্বীন শিক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণী পর্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়। মাসিক বেতন ১২৫-৪০০ টাকা, ভর্তি ফি ৫০০-১৫০০ টাকা পর্য। মহিলা মাদরাসাগুলোতে পুরুষ শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী লাঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নাই। পুরুষ শিক্ষকরা পর্দার আড়াল থেকে ছাত্রীদের শিক্ষা দেন। সব জায়গায় শয়তান আর ভালো মানুষ আছে। কিন্তু শুধু মাদরাসাগুলোই মানুষ বেশি চোখে দেখে। ” আর সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান যে ,সরকার যেনো মাদ্রাসাগুলোকে অনুমোদন দেয়। এসব মাদ্রাসাগুলোর সার্টিফিকেট সমমানের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটের সমান মর্যাদা দেয়া হয়।
মাদ্রাসাতুল বানাত (টাইটেল) বালিকা মাদ্রাসা : তেমনি আর একটি মহিলা মাদরাসা হলো জেল রোডের মাদ্রাসাতুল বানাত (টাইটেল) বালিকা মাদ্রাসা,সিলেট। এই মাদরাসাটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আল্লামা শায়খ আব্দুল্লাহ হরিপরী (র:)। বর্তমানে মাদরাসাটি পরিচালনা করছেন মাওলানা আব্দুল বাছিত বরকতপুরি। মাদরাসার শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়,তারা কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালা ও পাঠ্যক্রম অনুসারে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এখানে ১১ টি ক্লাসে প্রায় পাঁচ শ ছাত্রী লেখাপড়া করছে। মাসিক বেতন একশ টাকা থেকে ছয়শ টাকা। ভর্তি ফি একশ টাকা থেকে পাঁচশ টাকা। বেশির ভাগ ছাত্রী গরীব হওয়ায় তাদের কাছ থেকে বেতন নেয়া হয়না। মাদ্রাসায় শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন ২৩ জন। ছাত্রীদের বেতন এবং কিছু বিত্তবান মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় মাদ্রাসার ব্যয়ভার নির্বাহ হয়।
মাদরাসাতুল বানাত আল ইসলামিয়া : শাহজালাল উপশহরে আছে মাদরাসাতুল বানাত আল ইসলামিয়া। নদওয়াতুল বানাত মাদারিস লিল বানাত নামে নিজস্ব শিক্ষাবোর্ডের নীতিমালার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় এ মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস। তিনি জানান,অষ্টম শ্রেণী পর্য বাংলা ইংরেজি গণিতসহ নিজস্ব সিলেবাসে কুরআন হাদিস ভিত্তিক শিক্ষা দেয়া হয়। শিশু থেেেক দাওরা (টাইটেল) পর্য রয়েছে ১২ টি শ্রেণী। ছাত্রী সংখ্যা দুইশ। শিক্ষিকা নয় জন এবং শিক্ষক এগারো জন। এ মাদরাসাটিও কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তির আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। এখানে মাসিক বেতন এক হাজার টাকা। ভর্তি ফি আবাসিকদের জন্য তিনশ এবং অনাবাসিক ছাত্রীদের জন্য সাতশ টাকা।
পবিত্র রমজান উপলক্ষে কোরআন শিক্ষা প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি ফি দশ টাকা থেকে তিনশ টাকা পর্য নেয়া হয়। মাদরাসার ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে চাইলে জানানো হয়,রমজান উপলক্ষে অনজুমানে তালিমুল কোরআন বাংলাদেশ বোর্ডের অধীনে কোরআন শিক্ষার বিশেষ ক্লাস চলছে। তাই ছাত্রীদের সাথে এখন কথা বলা সম্ভব নয়।
মাদরাসার নিয়মিত শিক্ষকদের পাশাপাশি বাইরে থেকেও কিছু শিক্ষক এখানে এসে ক্লাস নেন। সরকারের কাছে কোনো দাবি আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস বলেন,বোর্ডের অন্য সদস্যদের মতামত না নিয়ে এ ব্যাপারে কিছু বলা সমীচিন হবে না। তবে তিনি মাদ্রাসাগুলোর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
উম্মাহাতুল মু’মিনিন মহিলা মাদরাসা : ঝালোপাড়ায় তিনজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মিলে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উম্মাহাতুল মু’মিনিন মহিলা মাদরাসা। একটি বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ক্বারি মওলানা রফিকুল ইসলাম মোস্তাক বর্তমানে প্রবাসে আছেন। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত পালন করছেন শিক্ষক নজরুল ইসলাম। পবিত্র রমজান উপলক্ষে মাদরাসায় পবিত্র কোরআন প্রশিক্ষণ চলছে। এ মাদ্রাসাটি উপশহর তের রতন ও ঢাকা দক্ষিণ মাদরাসার অধীনে পরিচালিত। এখানে শিশু শ্রেণী থেকে দাওরা পর্য পড়ানো হয়। শিক্ষক আছেন ১৪ জন আর শিক্ষিকা আছেন চারজন। ছাত্রী সংখ্যা প্রায় দুইশ। অষ্টম শ্রেণী পর্য দ্বিন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি গণিত বিষয়েও পড়ানো হয়। মাদ্রাসা থেকে সদ্য বের হওয়া টাইটেল পাশ করা করা ছাত্রী রোমানার সাথে কথা হয়। তিনি কোরআন প্রশিক্ষণ কোর্সের একজন শিক্ষিকা, দশ বছরের সংক্ষিপ্ত কোসে টাইটেল পাশ করে এখানে শিক্ষকতা করতে পারায় তিনি সােষ্ট।
মাদরাসাতুল হাসানাইন : মাদরাসাতুল হাসনাইন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে । সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ মিছবাহ উদ্দিন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি। মাদরাসার সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করছেন নির্বাহী পরিচালক মাওলানা ফারুক আহমদ। এখানে ১১ বছরেই টাইটেল কোর্স শেষ করা হয়। এ মাদরাসায় চার ডিসিমিল জমি দান করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন জিএম হাজী আবু তঈব। বেফাকুল মাদারিসিন আরাবিয়া বাংলাদেশ বোর্ডের অধীনে এ মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখানেও শিশু শ্রেণী থেকে দাওরা পর্য পড়ার ব্যবস্থা আছে। আবাসিক অনাবাসিক মিলিয়ে মাদ্রাসায় শতাধিক ছাত্রী আছে। ছয় শিক্ষক এবং চার শিক্ষিকা নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন। মাদরাসার আয়ের উৎস দুটি। এক ছাত্রী বেতন,দুই গুরাবা ফান্ড। এ ফান্ডে যে কেউ ইচ্ছে মতো দান করতে পারেন। ছাত্রী বেতন মাসিক ১০০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা। ভর্তি ফি ১৮২৫ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা। বেফাকুল মাদারিস বোর্ডেও অধীনে এখানেও রমজান মাসে কুরআন প্রমিক্ষণ হয়। এ মাদরাসায় কুরআনের তফসির ,হাদিস , ফিকাহসহ বাংলা ইংরেজি গণিত ইাতহাস এবং কোম্পিউটার প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে ছাত্রীদের যোগোপোযোগী শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানালেন শিক্ষকরা। মাদরাসা নির্বাহী পরিচালক মওলানা ফারুক আহমদ বলেন,মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনি। মাদরাসার শিক্ষক মাসুক আহমদ জানান, তারা আংশিক সতন্ত্র , আংশিক মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ছিলেন। সরকারি এমপিওভূক্ত হওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারেননি। তাই বাধ্য হয়েই বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াচ্ছেন। তিনি জানান,সিলেটে মত পার্থক্যের কারণে একাধিক বোর্ডের অধীনে মাদরাসাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সিলেবাস প্রণয়ন ও পাঠ্যবই নির্বাচনে সবারই বেগ পেতে হচ্ছে। একই বোর্ডের অধীনে সব মাদরাসাকে আনতে পারলে সবার জন্যই ভালো হয়।
সবারই একই মত ,সবগুলো মাদ্রাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে একই বোর্ডের আওতায় একই সিলেবাসে নিয়ে আসতে পারলে মহিলা মাদ্রাসাগুলোর আরো উন্নয়ণ সম্ভব।
ছেলেদের বেলায় টাইটেল শেষ করতে সময় লাগে ১৬ বছর। আর মেয়েদের বেলায় ১০ থেকে ১১ বছর। কেনো এই তফাৎ ? সবার একই জবাব,মেয়েরা তাড়াতাড়ি বড় হয়। তাড়াতাড়ি শিক্ষা জীবন শেষ করে তাড়াতাড়ি শশুর বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্যই সংক্ষিপ্ত কোর্স।