এবার বিটিভি দেখা যাবে ভারতে, ভারতীয়রা দেখবে তো?

placidপি.আর.প্ল্যাসিড,
১৯৮৬ সনের কথা। ভারত গিয়েছিলাম বেড়াতে। ভারতে প্রথম বেড়াতে গিয়ে যেখানে উঠেছিলাম, সেখানে আমাদের গ্রামের মতনই সব দেখতে। আর যেই বাড়িতে উঠেছি সেই বাড়ির গৃহকর্তী, সম্পর্কে ছিলেন আমার মাসিমা। ইন্ডিয়া সম্পর্কে এর আগে আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। ছাত্র জীবনে টিউশনী করে পড়াশোনা করার পাশাপাশি কিছু টাকা জমিয়েছিলাম, সেই টাকায় বিমানে চড়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে গিয়ে নামলাম ইন্ডিয়ার দমদম এয়ারপোর্ট (পশ্চিম বাংলা)।
সকাল সকাল সেদিন গিয়ে পৌছলাম ইন্ডিয়া। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বিভিন্ন লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে করে দেশ থেকে যার ঠিকানা নিয়ে গেলাম সেখানে গিয়ে পৌছতে বিকাল হয়ে গেল। যায়গার নাম এখন আর মনে নেই (সম্ভবত যাদবপুর)। সেই বয়সে দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে বেশ রোমাঞ্চ ছিল। কিন্তু শেষ গন্তব্যে গিয়ে পৌছানোর পর সেখানকার পরিবেশ দেখে মনে দুঃখ হলো। দুঃখটা হয়েছিল এই জন্য যে, এত টাকা খরচ করে প্লেনে আসলাম ইন্ডিয়া দেখতে, এসে দেখছি আমাদের গ্রামের মতই সব কিছু। টাকা খরচ করে এখানে এসে আর লাভ হল কি। এখানে তো আমাদের দেশের মতই ক্ষেত-খামার, গরু-ছাগল আর পাখপাখালির ছড়াছড়ি।
রাতে মাসিমার কাছে জানতে চাইলাম, এটাই কি তোমাদের কলিকাতা? মাসিমা তখন বুঝিয়ে বললেন, কলিকাতা যে ভিন্ন শহর। আমি জানতাম, কলিকাতা আর পশ্চিমবংগ যে ভিন্ন। তারপরেও আমার ধারনা ছিল, আমি বুঝি কলিকাতাতেই বেড়াতে আসলাম। দুইদিন না যেতেই কলিকাতা যাবার জন্য বিরক্ত করছিলাম মাসিমাকে। মাসিমা আমাকে একা কলিকাতা যেতে দিতে সাহস করছিলেন না। আবার আমার সাথে যাবার মতন কোন লোকও যে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কার সাথে আমাকে পাঠাবেন কলিকাতা?
আমাকে কলিকাতা শহরে পাঠানোর জন্য অনেক খোঁজাখুঁজি করে কাউকে না পেয়ে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগার যাবার জন্য কিছু লোক পেয়ে শেষে তাদের সাথে আমাকে কৃষ্ণনগর পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। আনন্দের সাথে আমি গেলাম কৃষ্ণনগর শহরে আমার এক আত্মীয়র বাসায়। যেখানে আমাকে পাঠানো হলো, ওরা আবার আমাদের বাড়ির পাশের বাড়ির লোক। ওদের সাথে কখনো দেখা না হলেও বাড়ির কর্তার সাথে তার একবছর আগেই দেখা হয়েছে বাংলাদেশে। থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। জমাজমি সংক্রান্ত বিষয়ে গিয়েছিলেন দেশে। ওনার কথা শুনেই গিয়েছিলাম ওখানে।
সেখানে যাবার পর একটা বিকাল কেবল আমার মন খারাপ করেছিল সেখানে। এরপর রাত হলে আমার মনে হলো, আমার জন্য যেন এটাই কলিকাতা, এখানেই যেন দেশ ভ্রমণের সর্বসুখ। এখান থেকে আর কোথাও আমার যাবার প্রয়োজন নেই। সেই বাড়িতে ছিল কয়েকজন বেশ সুন্দরী অল্প বয়সের মেয়ে। মেয়েরা বিকালে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে যথারীতি তাদের স্কুলের পড়াশোনা করে রাতের খাবার খেয়ে নিল। খাবার খেয়ে বাড়ির ছোট বড় সবাই তাদের সাদা কালো একটি ছোট টিভি সেটের সামনে জড়ো হয়ে বসলো। তখন পর্যন্ত বাড়ির ছেলেমেয়ে যারা আছে, তাদের সাথে আমার ভালো করে পরিচয়ও হয়নি। তাই কারো সাথে তেমন কথা বলা শুরু করি নি। আমি আমার মতন চুপ করে বসে রইলাম, দেখছি ওরা কি করে।
একটু পরেই দেখি আশেপাশের লোকজন এসে ঘর ভরে গেছে। জানতে চাইলাম এই ভাবে এলাকার লোক এসে ভীড় করার কারণ কি। ওরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ওমা তুমি জানো না? আজকে না তোমাদের দেশের টিভিতে নাটক আছে? আমি মনে মনে অবাকই হলাম, আমাদের দেশের টিভিতে নাটক, তাই এখানে ওদের কি। পরে বিষয়টি বুঝতে পারলাম ওরা যে ঢাকার টিভি নাটক দেখার জন্য কতটা অস্থির আর পাগল। (ঢাকার টিভি বলতে বিটিভির নাটক।)
এরপর সেখান থেকে একদিন গেলাম হাওড়া হয়ে টালিগঞ্জ, নিউমার্কেট আরো কত জায়গাতে। কলিকাতা শহর ঘুরে দেখে বিকালের দিকে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে গেলাম এক আত্মীয়র বাসায়। ওরাও কিছুদিন আগে সপরিবারে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। বাড়ি আমাদের এলাকাতেই। দেশে আসার পর যে ভাবে আমার বাবা মা ওদের আপ্যায়ন করেছে, সেটা মনে করেই গিয়েছিলাম ওদের ওখানে। গিয়ে দেখি ওরা দুপুরের খাবার খাচ্ছে। ভেবেছিলাম দুপুরে ওদের ওখানে খাওয়া যাবে। কিন্তু না, ওরা খাবারের পরিবর্তে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো রাতে ওদের সাথে ঢাকার টিভি নাটক দেখে যাবার জন্য।
তখনও ওরা আমাকে খাবার খেয়ে এসেছি কিনা কিছু জানতে চাইল না দেখে, নিজেই বললাম আমার যে প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। বলার পর বাড়ির লোকেরা বলল, আগে বলবে না, আমরা তো সব খেয়ে উঠেছি। বসো চা মুরি দিচ্ছি। চা মুড়ি দিল খেতে। চা মুড়িতে কি আর পেট ভরে। ভাত খেতে আমি উঠে কোথাও যেতেও পারছিলাম না। বাইরে গেলে রাস্তা চিনে ফিরেও আসতে পারবো না জানি। আবার বারবার টেলিভিশনে ঢাকার নাটক দেখার আমন্ত্রণ করছে। রাতে হয়তো আমাকে ভালো কিছু খাবার ব্যবস্থা করবে মনে করে আমি নাটকের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।
পাশেই উঠোনের মতন খালি এক জায়গায় একজন একটা সাদা কালো টিভি সেট বের করে টেবিলের উপর বসালো। মুহুর্তের মাঝে সেখানে দেখলাম আশেপাশের লোক এসে ভরে গেল। উদ্দেশ্য ঢাকার বিটিভিতে সাপ্তাহিক নাটক দেখবে। আমি ওদের বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে ঢাকার নাটক দেখার আগ্রহ দেখে অবাক হলাম। এত অধীর ভাবে ওরা টিভি দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল আর নাটক শুরু হবার পর থেকে এমন মনযোগ দিয়ে নাটক উপভোগ করছিল দেখে সত্যি আমি অবাক হলাম বিষয়টির জন্য। ঢাকার টিভি চ্যানেলের নাটক গুলোর প্রশংসায় দেখলাম কলিকাতা আর নদীয়ার আত্মীয় স্বজনরা পঞ্চমুখ।
অনেকদিন পর সম্প্রতি আমি গিয়েছিলাম কলিকাতা, নদীয়া আরো কয়েক জেলাতে বিশেষ কাজে। সেখানে ওরা এখন আর দেখলাম ঢাকার কোন টিভি চ্যানেল নামই নিচ্ছে না, প্রোগ্রামের তো দূরের কথা। অপর দিকে আমাদের দেশে দেখলাম পুরো ভিন্ন চিত্র। আমি যদি দেশে দশটা বাসায় যাই, তাহলে দেখি দশটা বাশাতেই (যদি টিভি অন থাকে তাহলে) তারা ইন্ডিয়ার চ্যানেল ছেড়ে ইন্ডিয়ান অনুষ্ঠান দেখছে। দেখছে বলতে, ওরা যেন ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠান দেখার জন্য অন্ধ পাগল। ছেলে বুড়ো সব বয়সের লোক একই ভাবে দেখে সেই অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশে আজকাল ইন্ডিয়ার বিভিন্ন চ্যানেলে ওদের প্রোগাম দেখার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অনেকেই বলেছেন, দেশের চ্যানেল কি দেখবো? দেখার মতন কি ভালো কিছু আছে? আর যাও কিছু থাকে চ্যানেল ওলারা বিজ্ঞাপন দিয়ে ভরে রাখে। এসব দেখার সময় নেই আমাদের। হুম, বিষয়টি নিয়ে মনে হচ্ছে আজকাল আমাদের জাতীয় পর্যায় আলোচনা হচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেল গুলি আমাদের দেশে খুব সহজে দেখা যায়। এটা যত বড় সত্য কথা, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের চ্যানেল গুলিতে যে ভালো মানের তেমন কোন প্রোগ্রাম করা হয় না। এটা আমার কথা নয়, দর্শকদের মন্তব্য।
এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের দেখা, জানা, বোঝা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে রপ্ত করা দরকার আছে। এর অর্থ এই নয় যে নিজেদের সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে বা নষ্ট করে অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণ করা জরুরী বা বাঞ্ছনীয়। ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল গুলো সহজে দেখার মাঝে যতনা আনন্দ, তার চেয়ে অনেক গুন বেশী আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে ধংস করার ভয়। আমার মনে হয় সহজলভ্য বিষয়টির ব্যাপারে শীঘ্রই আমাদের অনেক বেশী সচেতন হতে হবে, তা না হলে পুরোটাই যে গ্রাস করে ফেলবে সেই সংস্কৃতি।
দেশের টিভি অনুষ্ঠান গুলোতে ভালো বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না বলে অনেকে অভিযোগ করেন। ভালো প্রোগ্রাম করলেও আবার ঠিক মতন টাকা পাওয়া যায় না। এমন কত অভিযোগ আছে আমাদের এই লাইনের লোকদের। অনেককেই বলতে শুনি, ভারতীয় চ্যানেল দেখা বন্ধ করতে হবে। অথচ বলি না, দেশের টিভি চ্যানেল গুলোর অনুষ্ঠান উন্নত মানের করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার দেশে করতে বিজ্ঞাপন দেয় দেশের বাইরের টিভি প্রোগ্রামে অথচ আমাদের দেশে কত ভালো মেধা সম্পন্ন সৃষ্টিশীল লোক আছেন তাদের দিয়ে ভালো মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান করাতে মোটেও তাদের আগ্রহ দেখি না। অনেকেই আবার বলে থাকেন বিটিভির কোন অনুষ্ঠানই দেশের মানুষ দেখে না। আমার মনে হয় বিজ্ঞাপন দাতাদের সহায়তায় অনুষ্ঠানের মান ভালো করতে পারলে দেশের দর্শকরা আবার দেশের টিভি (বিটিভির) চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহ দেখাবে।
সরকার দেশের সরকারী টিভি চ্যানেল (বিটিভি) পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে নতুন করে দেখার ব্যবস্থা করছেন শুনে কার না ভালো লাগে। বিষয়টি লেনদেনের মতই যেন মিমাংশিত। ওদের চ্যানেল এখানে দেখা যায় সুতরাং আমাদের চ্যানেলও ওখানে দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু ওরা আমাদের চ্যানেল দেখবে কেন? দেখার কি আছে এমন যে ওরা দেখবে? কেবলই সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের গুনকীর্তন শুনতে আর দেখতে বিটিভি দেখবে নাকী ভালো বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান দেখার জন্য দেখবে।
বিটিভি চ্যানেল আমাদের একসময় ভালোছিল। ভালো ছিল এর প্রোগ্রামের মানও। কিন্তু এখন কি আর হচ্ছে সেই মানের নাটক বা অন্য কোন অনুষ্ঠান? অনুষ্ঠান ভালো না হলে ভারতীয় বাংগালীরা দেখবে কেন আমাদের এই চ্যানেল। আশা করি সরকারকেই ভাবতে হবে এই সরকারী চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে। কতদিকে কতা টাকা খরচ হচ্ছে। এমনকি এই বিটিভিতেও দেখা যাবে খোঁজ নিলে টাকার অপচয় বা অপব্যয় হচ্ছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের খাতে কি হচ্ছে যথাযত পরিকল্পনা মাফিক ব্যয়?
অনুষ্ঠানের মান ভালো করে যদি চ্যানেল চালাতে সমস্যা হয় তাহলে প্রয়োজনে নাগরিকদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ( যেমনটি করা হয় জাপানের জাতীয় টিভি চ্যানেল এন.এইচ.কে-এর বেলাতেও।) তারপরেও অন্যান্য বেসরকারী চ্যানেল গুলির সাথে ভালো উন্নত ও রুচি সম্পন্ন অনুষ্ঠান করে কম্পিটিশনে টিকে থাকার জন্য ভালো মানের অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা করা দরকার। তবেই দেশে ও দেশের বাইরে মানুষ দেখবে এই চ্যানেল। তবে সে সাথে ভারতীয় বাংগালীরাও দেখার আগ্রহ বোধ করবে আমাদের এই বিটিভি চ্যানেল।
যেখানে আমাদের দেশেই দর্শক তুলনামূলক ভাবে এবং প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম, সুতরাং পদ্ধতিগত ভাবে এর দর্শক সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করলে দেশবাসী এই চ্যনেলটিকে নিয়মিত দেখার যেমন আগ্রহ দেখাবে তেমনি হবে এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানও। এবং বহির্বিশ্বেও এর দর্শক সংখ্যা বাড়বে। তখনই না হয় ভারতে এই চ্যানেল দেখার ব্যবস্থা করলে হবে এটি একটি শুভ ও স্বার্থক চুক্তি। আমরা সেই বাস্তব ধর্মী চিন্তার বাস্তবায়ন আশা করছি।