খালেদার আবেদন নথিভুক্ত, শুনানি পেছালো এক মাস
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দায়ের করা আবেদন নথিভুক্ত করেছেন আদালত। একইসঙ্গে মামলা দু’টির কার্যক্রম ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার গতকাল এ আদেশ দেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগের মতই তার আইনজীবীদের মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দিতে পারবেন বলেও আদেশে উল্লেখ করেন বিচারক।
পরোয়ানার বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন করেছি। আদালত কোন আদেশ দেননি। নথিভুক্ত করে রেখেছেন। তাই যাবতীয় কার্যক্রম পরবর্তী শুনানির আগ পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। এক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষে বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল আছে। এখন তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন আইনি বাধা নেই।
গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াসহ এ মামলার তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত অপর দুই আসামি হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া তারেক রহমানকে ৪ঠা মার্চ সশরীরে হাজির করার জন্য তার আইনজীবীদের নির্দেশ দেয়া হয়।
গতকাল এ মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয় ওই এলাকায়। সোয়া এগারটায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিঞা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, জামিন বহাল, সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন পেছানোসহ আলাদা সাতটি আবেদন করেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলসহ অন্য আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাদের আবেদন উত্থাপন করলে আদালত প্রশ্ন রাখেন- এর কোন আইনি ভিত্তি আছে কিনা? এ সময় দুদকের পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে তার পক্ষে কেউ আদালতে কথা বলতে পারবেন না। তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় তাদের পক্ষে কেউ আবেদনও জমা দিতে পারবেন না। তাই নির্ধারিত সাক্ষ্য নেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
এ পর্যায়ে সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাকে আমার বক্তব্য রাখতে দেন। আমি আইনজীবী হিসাবে আমার বক্তব্য রাখবো। আপনি আমার বক্তব্য গ্রহণ করবেন কি করবেন না, তা আপনার এখতিয়ার। আমার কথা শেষ হলে আমি হয়তো বুঝাতে পারবো যে- বেগম জিয়ার পক্ষে আমি কথা বলার এখতিয়ার রাখি কিনা? এ সময় দুদকের আইনজীবীরা বাধা দেন এবং হইচই শুরু করেন। বিপরীতে বেগম জিয়ার পক্ষের আইজীবীরাও হইচই শুরু করেন। পরে আদালত এ জে মোহাম্মদ আলীকে কথা বলার সুযোগ দেন।
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপনি ২৫শে ফেব্রুয়ারি যে আদেশ দিয়েছেন তা পক্ষপাতদুষ্ট। আপনি ৬৩ কার্যদিবসে অনুপস্থিতির কথা বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে সরকারদলীয় কোন না কোন সংগঠনের দ্বারা। এমনকি সরকারের শপথ নেয়া মন্ত্রীও তার বাড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তার পক্ষে সম্ভব নয় বাইরে আসা। আপনাকে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কেবল শুনার জন্য শুনলে ন্যায়বিচার হবে না। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে এসেছে- প্রথমে পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। এখন বলছে- পাইনি। আমাদের নিয়ে খেলা করলে চলবে না। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে মামলার কার্যক্রম চলেছে। সাক্ষীও হয়েছে। এখন একটা তারিখে অনুপস্থিত থাকলে ভিন্ন আদেশ দিতে হবে কেন? তার জামিন নিয়ে তামাশা চলছে। আমরা উদ্বিগ্ন। এ পর্যায়ে আদালত তাকে শুনানি সংক্ষিপ্ত করতে বলেন। জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ ৫ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি করি। তারাও আমাকে ডিস্টার্ব করেন না। আপনার এখতিয়ার কতটুকু তা আপনাকে বোঝাচ্ছি। এ সময় আদালত বলেন, এটা ক্লাসরুম না। আপনি আমাকে যেভাবে পাঠদান করছেন সেই বয়সে আমি নাই। এ পর্যায়ে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, উনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। তাদের আমরা টু স্টার আইনজীবী বলি। বাংলাদেশে মাত্র ৪৩ জন সিনিয়র আইনজীবী আছেন। তাকে আপনার শুনতে হবে। বেগম জিয়ার মামলা নিয়ে মানকি বিজনেস (বানর খেলা) চলছে। আদালত মানকি বিজনেসের জায়গা নয়। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপনি এই মানসিকতা রাখবেন না যে, আপনাকে শিখাচ্ছি। আপনি জামিন বাতিল করতে পারেন না। ২৫শে ফেব্রুয়ারির আদেশ ত্রুটিপূর্ণ। এটা সংশোধন করা প্রয়োজন। অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল এ পর্যায়ে বলেন, পরোয়ানা থাকাকালে কোন আসামির পক্ষে কাউকে কথা বলার সুযোগ দেয়া যেতে পারে না। আত্মসমর্পণের কাজ ছাড়া আসামির আর কোন উপায় নাই। এরপর বেগম জিয়ার পক্ষে কথা বলেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার। তিনি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার চাই। আমরা ন্যায়বিচারের জন্য আদালতকে সহায়তা করতে চাই। একজন আইনজীবী হিসাবে এটাই আমাদের দায়িত্ব। বেগম খালেদা জিয়া আদালতে আসতে চান। কিন্তু পরিস্থিতি আসার পক্ষে নয়। বিষয়টি আপনাকে উপলব্ধি করতে হবে। গত দিবসে তার গাড়ি বহরে হামলা হয়েছে। তাকে শুনে আদালত আদেশ দেন।
মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমরা কোন আক্রোশের কথা বলছি না। আমাদের কোন উদ্দেশ্যও নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আসামিপক্ষের আবেদনের বিরোধিতা করে কাজল বলেন, তাদের দরখাস্ত গ্রহণ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আসামি ফৌজদারি আইন মোতাবেক কোন সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ফৌজদারি আইনের এমন কোন বিধান দেখাতে পারবেন না যেখানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আসামিরা কোন সুযোগ সুবিধা পেতে পারে। শুনানি শেষে বিচারক বলেন, আমি এই বিচারকাজকে দৃশ্যমান করতে চাই। এখানে কোন পক্ষপাতিত্ব করছি না। আমি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইনের মধ্যে থাকতে চাই। আপনারা (আইনজীবীরা) যতটুকু দিতে পারবেন আমি ততটুকু ভাল করতে পারব। বিচারক বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি (খন্দকার মাহবুব হোসেন) বলেছেন এই আদালত অবৈধ, বেআইনি। কিন্তু অবৈধ আদালতে বৈধ দাবির আবেদন করা হচ্ছে। একপর্যায়ে বিচারক আবু আহমেদ জমাদার খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রত্যাহারের আবেদন নথিভুক্ত করে আগামী ৫ই এপ্রিল মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হবে জানিয়ে আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করে এজলাস ত্যাগ করেন। পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে বেগম খালেদা জিয়া আজ আদালতে আজির হন নাই। আদালত আমাদের কোন আবেদনই নামঞ্জুর করেন নাই। আবেদন নথিভুক্ত করে আগামী ৫ই এপ্রিল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার জামিন বহাল রেখে তার অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধিত্ব করার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর হয় তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে নয়তো আসামিকে আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করতে হবে। এর বাইরে আর কোন সুযোগ নেই। আদালত শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রেখে আবেদন নথিভুক্ত করেছেন। কাজল বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল আছে ও থাকবে। তিনি গ্রেপ্তারও হতে পারেন আবার আদালতে আত্মসমর্পণও করতে পারেন। সব ধরনের সুযোগই রয়েছে। ওদিকে, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও আলিয়া মাদরাসার কাছাকাছি তিনটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।