মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তাসহ দুজনকে কুপিয়ে হত্যা

মর্মাহত যুক্তরাষ্ট্র, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি

11498_f1ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকাস্থ মার্কিন মিশনের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানসহ দুই জনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় জুলহাজের ফ্ল্যাটে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত মাহবুব রাব্বী তনয় জুলহাজের বন্ধু। হামলার সময় দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বাসার নিরাপত্তা কর্মী পারভেজও আহত হন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জুলহাজ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ সম্পাদনা করতেন তিনি। তিনি সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপুমণির খালাতো ভাই। এই হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস।  অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সেন্টার ফর প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, কলাবাগান থানাধীন লেকসার্কাস এলাকার ৩৫ নম্বর উত্তর ধানম-ির নিজেদের বাড়ির দোতালায় থাকতেন জুলহাজ মান্নান। সাত তলা ওই বাড়ির নিচতলায় পারভেজ মোল্লা নামে একজন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করছিল। গতকাল বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে ৫-৬ জন যুবক দুটি পার্সেল নিয়ে ওই বাসায় যায়। তারা বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীকে জুলহাজ মান্নানের নামে পার্সেলগুলো এসেছে বলে জানায়। দারোয়ান তাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে দোতালায় উঠলে ওই যুবকরাও julhas_mozeenaদোতালায় উঠে যায়। এসময় দরজা খুলে জুলহাজ মান্নান বেড়িয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় আঘাত করা হয়। জুলহাজ দৌড়ে ভেতরে ঢুকতেই দুর্বৃত্তরাও তার সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। বাসার ড্রয়িং রুমে জুলহাজের মাথায় এলোপাথারি কুপিয়ে আঘাত করে। ভেতরের ঘরে তনয় নামে জুলহাজের এক বন্ধু ছিলেন। চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে এলে তাকেও এলোপাথারি কুপিয়ে আহত করে হামলাকারীরা। এর আগে বাসার দারোয়ান পারভেজ বাঁধা সৃষ্টি করতে চাইলে তাকেও কোপায় তারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্বৃত্তরা বাসা থেকে বেড়িয়ে পাশের মসজিদ গলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। সেখানে আগে থেকেই টহলে থাকা একটি পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। চিৎকার শুনে পুলিশ ওই যুবকদের আটকানোর চেষ্টা করলে তারা পুলিশের ওপরও হামলা চালায়। এতে এএসআই মমতাজ নামে এক পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি করলেও দুর্বৃত্তদের কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরাও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে। পাশের তেতুল মাঠে আড্ডা দেয়া স্থানীয় কিছু তরুণ ও যুবক দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে। তাদের একজন আনোয়ারুল ইসলাম লিঙ্কনের মাথায় ও হাতে আঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। লিঙ্কনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। লিঙ্কন আইডিয়াল কমার্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই বাসায় দুজনকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া দুবৃৃত্তদের বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে। তারা জিন্সের প্যান্ট ও আকাশী এবং ছাই রঙের শার্ট পড়ে এসেছিলেন। প্রত্যেকের কাঁধে একটি করে ব্যাগ ছিল। একজনের হাতে অস্ত্র দেখেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন। তবে ওই বাসার দারোয়ান পারভেজ জানান, দুর্বৃত্তরা সবাই একই রঙের টি-শার্ট পড়ে এসেছিল। তারা একটি কুরিয়ার কোম্পানীর নাম বলে বাসায় ঢুকে। পারভেজ জানান, তাদের রেখে দ্বিতীয় তলায় জুলহাজের ফ্ল্যাটের দরজায় নক করলে জুলহাজ বেড়িয়ে আসেন। তার নামে কোনও পার্সেল আসার কথা ছিল না বলে দরজা লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এসময় দুর্বৃত্তরা জোর করে বাসার ভেতরে ঢুকে এলোপাথারি কুপিয়ে চলে যায়। এসময় অপর একজন দুর্বৃত্ত তার ওপর হামলা চালায় বলে জানান পারভেজ। পারভেজ জানান, তিনি চিৎকার করতে থাকেন। জুলহাজও ভেতর থেকে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু দুর্বৃত্তরা কয়েক মিনিটের মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাসার ড্রয়িং রুমের মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল জুলহাজের দেহ। তার মাথায় অনেকগুলো কোপের আঘাত রয়েছে। আর শয়ন কক্ষে পড়ে ছিল তনয়ের লাশ। ওই বাসায় জুলহাজের বৃদ্ধ মা ও কাজের মেয়ে ছিলেন। ঘটনার সময় তারা রান্না ঘরে ছিলেন জানা গেছে। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা সিআইডি ক্রাইম সিনের এক সদস্য বলেন, দুজনেরই মাথা ও ঘাড়ে কোপের চিহ্ন। প্রতিটি আঘাতই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। একারণে তাৎক্ষণিক রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছেন। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুজনকেই পাইকারী হারে কোপানো হয়েছে।’
এদিকে বাসার ভেতরে ডাবল মার্ডারের খবর পেয়ে র‌্যাব-পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ভীড় জমে কৌতুহলী মানুষেরও। সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, সাবেক পররারাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমণি, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান, গোয়েন্দা প্রধাণ লে. কর্ণেল আবুল কালাম আজাদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি টার্গেট কিলিং। এই কিলিং মিশনে ছয়জন অংশ নিয়েছিল। তারা সময় নিয়েছে পাঁচ মিনিট। তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ডলফিন গলি দিয়ে পালিয়ে গেছে তারা। তারা কারা, কেন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে বের করা হবে। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, এই হত্যাকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত, আগের ঘটনার সঙ্গে এটির মিল রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আমরা খুনিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের পাশাপাশি ছায়াতদন্ত করছি।
হত্যার ধরণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, উগ্রপন্থী কোনও গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। নিহত জুলহাজ মান্নান সমকামীদের সমর্থন ও তাদের নিয়ে কাজ করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত পয়লা বৈশাখের দিন জুলহাস মান্নানের নেতৃত্বে সমকামীদের একটি র‌্যালী মঙ্গলশোভাযাত্রায় যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সেদিন শাহবাগ থানা পুলিশ তাকে আটকের পর রাতে ছেড়ে দেয়। ঘটনাস্থলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি পরিকল্পিত। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দুর্বৃত্তরা যে দুটি পার্সেল নিয়ে জুলহাজ মান্নানের বাসায় প্রবেশ করেছিল তা খুলে দেখা গেছে তাতে কাগজ ও ডাবের খোসা দিয়ে ভরা ছিল। ভবনের তৃতীয় ও চতর্থ তলার বাসিন্দারা চিৎকারের শব্দ শুনলেও ভয়ে কেউ বাসা থেকে বের হননি। স্বজনরা জানান, নিহত জুলহাজের বাবার নাম মৃত আব্দুল মান্নান। তিনি উপ-সচিব ছিলেন। মায়ের নাম সকিনা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জুলহাস ছিলেন মেজো। বড় ভাই ইমন গুলশানে থাকেন। আর একমাত্র বোন থাকেন আমেরিকায়। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তির নরিংপুর এলাকায়। ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ঢাকার সদ্য সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রোটকল অফিসার হিসাবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এদিকে জুলহাজের বিষয়ে তথ্য জানা গেলেও তার বন্ধু মাহাবুব তনয়ের বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য জানা যায়নি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিহত তনয় লোক নাট্যদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে সে আশা ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছিল। সে থাকতো মিরপুরের শেওড়াপাড়ায়।
সিসিটিভির খোঁজে পুলিশ: ঘটনার পর থেকেই দুর্বৃত্তদের সনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজের খোঁজে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে দুর্বৃত্তরা যেই রাস্তায় ওই বাসায় গিয়েছে এবং পালিয়ে যাবার সময় যেই সড়ক ব্যবহার করেছে সেখানকার কয়েকটি বাসার সামনে লাগানো সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে খুনিদের সনাক্তের চেষ্টা চলছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্ণেল আবুল কালাম আজদ বলেন, দুর্বৃত্তদের ধরতে মাঠে নেমেছে র‌্যাব। সবরকমের পন্থা অবলম্বন করেই কাজ শুরু হয়েছে।
দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে গিয়ে বিপাকে: পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে গিয়ে হাতে ও মাথায় আঘাত পেয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আনোয়ারুল ইসলাম লিঙ্কন। পাশের পোড়াবাড়ি বস্তির বাসিন্দা লিঙ্কন স্থানীয় আইডিয়াল কমার্স কলেজের ছাত্র। ঘটনার পর দুর্বৃত্তদের ধরতে দৌড়ে যান তিনি। কিন্তু ঘটনার পর পুলিশ তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রাত ১১টার দিকে ওই বাসা থেকে নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়ার পুলিশের একটি ভ্যানে লিঙ্কনকেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। লিঙ্কনের মা আনোয়ারা বেগম জানান, আমার ছেলে কোচিং করে বাসায় ফিরছিল। এইসময় ছিনতাইকারী মনে করে সে দৌড়ে ধরতে যায়। আনোয়ারা বেগম বলেন, পুলিশ বলছে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিবে। এখন কি হয় আল্লাহই জানে।
মর্মাহত যুক্তরাষ্ট্র, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি
ঢাকাস্থ মার্কিন মিশনের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানের খুনিদের গ্রেপ্তারে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে ওই খুনের ঘটনাকে ‘ অর্থহীন সহিংসতা’ আখ্যা দিয়ে তিনি এর তীব্র নিন্দা জানান। রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা এ বর্বরতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। জুলহাজ মান্নান এবং অন্য এক তরুণ বাংলাদেশির নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। মার্কিন দূতাবাসে আমাদের যাদের জুলহাজের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের কাছে তিনি সহকর্মীর চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। তিনি আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জুলহাজ এবং তার সঙ্গে হামলায় হতাহতদের জন্য আমাদের প্রার্থনা রইল।
নৃশংস হত্যাযজ্ঞ নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষ: অ্যামনেস্টি
জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয় মজুমদার হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে লন্ডন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো কমিয়ে আনতে ব্যর্থ উল্লেখ করে সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের প্রথম এলজিবিটিআই ম্যাগাজিন রুপবানের সম্পাদক (৩৫) ও তার বন্ধু তনয় মজুমদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে হামলাকারীরা নিজেদের কুরিয়ারের লোক বলে জুলহাজের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক চম্পা পাটেল বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেনীর শান্তিপূর্ণ অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য যে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে তা মর্মাহত করার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার কয়েক দিন পর এলজিবিটিআই ম্যাগাজিন সম্পাদক ও তার বন্ধু’র নির্মম হত্যাকান্ড এ বিষয়টিই জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।’ তিনি আরও বলেন, এ মাসেই এখন পর্যন্ত এমন নিন্দনীয় চারটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এটা বিস্মিত হওয়ার মতো যে, এসব বর্বরোচিত হামলার জন্য কাউকে এখনও বিচারের আওতায় আনা হয়নি এবং সুশীল সমাজে হুমকির মুখে থাকা সদস্যদের বলতে গেলে কোন সুরক্ষা দেয়া হয় নি। জীবনের অধিকার রক্ষা করা ও এর প্রতি সম্মান দেখানোর আইনি দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের। যারা সাহসিকতার সঙ্গে এবং সহিংসতা পরিহার করে নিজেদের মত প্রকাশ করে তাদের সুরক্ষা দিতে এবং খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই জরুরিভিত্তিতে মনোযোগ দিতে হবে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই শক্তভাবে এসব বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানাতে হবে, যেটা করতে তারা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।’
জুলহাজ মান্নান ও তনয় মজুমদার হত্যার নিন্দা জানিয়ে দেয়া প্রেস রিলিজে আরও বলা হয়, বাংলাদেশি দন্ডবিধির অধীনে সমকামী সম্পর্ক অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়। নির্বাসিত এলজিবিটিআই অ্যাক্টিভিস্টরা অ্যামনেস্টিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে হুমকির বিষয়টি রিপোর্ট করতে গেলে পুলিশ তাদের বলেছে, তাদের ‘অস্বাভাবিক অপরাধের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতে পারে।
চম্পা পাটেল বলেন, ‘বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এসব সহিংস গ্রুপগুলোকে বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে আর হামলাকারীরা তাদের টার্গেটের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে। এখন এতে যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং এলজিবিটিআই অ্যাকটিভিস্ট।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশি পুলিশের দেশের এলজিবিটিআই সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। তাদের হয়রানী করা বা গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়া নয়, যেমনটা তারা করে আসছেন।’
বিবৃতির শেষে বলা হয়, চলতি মাসের শুরু থেকে বাংলাদেশি অ্যাকটিভিস্ট ও তাদের সহযোগীদের চারটি নির্মম হত্যাকান্ড ঘটেছে। ৭ই এপ্রিল মুখোশধারী চার ব্যক্তি নাজিমুদ্দিন সামাদকে (২৮) চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। ২০১৩ সালে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রকাশিত ৮৪ ব্লগারের হিট লিস্টে নাম ছিল সামাদের।
২৩শে এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনবিদিত অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিক (৫৮) শহরের বাস স্টেশনের দিকে হেটে যাওয়ার সময় চাপাতি হাতে হামলাকারীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। ২০১৫ সালে কুপিয়ে হত্যার শিকার হয় ৫ জন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার। এ ধরণের প্রথম হামলা ঘটে ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া হত্যাকান্ডগুলোয় একজনকেও বিচারের আওতায় আনা হয় নি।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এলজিবিটিআই সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেয়া তো দূরে থাক, তাদেরকে ‘ক্রিমিনালাইজ’ করে চলেছে। তাদের ‘আরও কম উস্কানিমূলক’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশি অনেক এলজিবিটিআই অ্যাকটিভিস্ট তাদের বিরুদ্ধে থাকা ঝুঁকির কারণে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছে।
সিপিজের নিন্দা: জুলহাজ মান্নান হত্যার নিন্দা জানিয়েছে সেন্টার টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষা ও গণমাধ্যম স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক এই সংগঠনটি বলেছে, সিপিজে বাংলাদেশি সাংবাদিক জুলহাজ মান্নান হত্যার নিন্দা জানায়। তিনি সমকামী অধিকার ভিত্তিক ম্যাগাজিন রুপবানের সিনিয়র সম্পাদক ছিলেন এবং ইউএসএইড এর হয়ে কাজ করতেন। তার নিজ বাড়িতে এক বন্ধুসহ কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রিপোর্টের উদ্বৃতি দিয়ে সিপিজের বিবৃতিতে বলা হয়, তৃতীয় আরেক ব্যক্তি হামলায় আহত হয়। ২০১৫ সালে চরমপন্থীদের হাতে ৪ জন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার পর এ হত্যাকান্ড ঘটলো। সিপিজের এশিয়া কার্যক্রম সমন্বয়ক বব ডাইয়েটজ বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অবিলম্বে জুলহাজ মান্নান হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে হামলার মুখে রয়েছে। আর সরকার এসব হত্যাযজ্ঞ বন্ধে বা ঝুঁকির মধ্যে থাকা গোষ্ঠীগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামান্যই করেছে।’ (মানবজমিন)