অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নে চাঁদাবাজি ও হরিলুটের লড়াই
মো. ফখরুল ইসলাম :: সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন ও জিন্দাবাজার শাখার মধ্যে চলছে ক্ষমতার লড়াই। জেলা শাখা ও জিন্দাবাজার শাখার নেতৃবৃন্দের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ অনেক। পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি ছাড়াও একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। জেলা অটোরিক্শা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন ৪১ বছরে হয়নি এবং সিলেকশনের মাধ্যমে পকেট কমিটি ক্ষমতাসীন বলে জিন্দাবাজার শাখার অভিযোগ। অপর দিকে কেন্দ্রীয় কমিটির অভিযোগ,জিন্দাবাজার শাখা বেআইনিভাবে শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছে।
বিশাল এই শ্রমিক সংগঠনটি ১৯৭৫ সাল হতে নিবন্ধিত গঠনতন্ত্র মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে সিলেট জেলায় অটোরিক্শা শ্রমিকদের ১০০টি আঞ্চলিক কমিটি রয়েছে।
জেলা অটোরিক্শা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় অফিস সূত্র দাবি করে, জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা শাখা নামে একটি আঞ্চলিক কমিটি কোর্ট পয়েন্ট, সুরমা পয়েন্টসহ কয়েকটি স্ট্যান্ড পরিচালনা করে। বর্তমান জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা শাখা জেলা কার্যকরী পরিষদের কোনো নির্দেশ না মেনে এবং গঠনতন্ত্র ও জেলা কার্যকরী পরিষদের নির্দেশ অবজ্ঞা করে ইচ্ছামাফিক চাঁদা তোলে। শ্রমিকদের সাথে অসদাচরণসহ বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন, আর্থিক অনিয়ম এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি এই শাখার সভাপতি সালমান আহমদকে বহিষ্কার করে সংগঠনে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। একই সাথে সহ-সভাপতি হাসনু মিয়াকে দেওয়া হয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন শ্রমিকের নিকট থেকে অভিযোগ আসে। তদন্তসাপেক্ষে এই সব অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ৭ মার্চ এই কমিটিকে যাবতীয় হিসাব দেওয়ার জন্য পত্র দেওয়া হয়। তারা হিসাব না দেওয়ায় ও চাঁদা আদায় বন্ধ না করায় গত ১৭ মার্চ জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা শাখা কমিটিকে সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়ে গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রেরণ করা হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ । নোটিশের সঠিক জবাব না দেয়া, চাঁদা আদায় বন্ধ না করা এবং সংগঠন ও গঠনতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা করার কারণে গত ২৭ মার্চ জেলা কার্যকরী পরিষদের সভায় উপস্থিতির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা শাখা কমিটিকে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এরপরও জিন্দাবাজার শাখা সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকায় গত ৯ এপ্রিল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়া বাদি হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি তদন্তাধীন রয়েছে।
অপর দিকে জিন্দাবাজার শাখার নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, সিলেট জেলা অটোরিক্শ শ্রমিক ইউনিয়ন (৭০৭ ) প্রতিষ্ঠার পর হতে অদ্যাবধি প্রায় ৪১ বছর গত হলেও আজ পর্যন্ত গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। মো. জাকারিয়া ১৯৯৭ সাল হতে তার স্বগোত্রীয় লোভী ও মাস্তান প্রকৃতির লোকদের দ্বারা সিলেট জেলা অটোরিক্শা শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা কমিটির যাবতীয় কার্যক্রম ‘অবৈধভাবে অসৎ উপায়ে’ পরিচালনা করে আসছেন। কেউ এইসব কার্যকলাপের প্রতিবাদ করলে তাকে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলামোকদ্দমা দিয়ে হেনস্তা করা হয় । সিলেট জেলাভিত্তিক কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি আজাদ মিয়া রেইল গেইট শাখার নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় পেশিশক্তির জোরে জাকারিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে বহাল থেকে শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে সাহাব উদ্দিন, মানিক খাঁন, ইকবাল, সুন্দর আলী খাঁন ও মামুন প্রমুখ একইভাবে বিভিন্ন শাখার কমিটির নির্বাচনে জয় লাভে ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদবি বাগিয়ে ‘অবৈধ কর্মকান্ড’চালাচ্ছেন ।
জিন্দাবাজার শাখার বহিষ্কৃত সভাপতি সালমান আহমদ জানান, ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পকেট কমিটির মাধ্যমে জাকারিয়া আহমদ সিলেট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও আজাদ মিয় সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। প্রতি দু’বছর পর একটি শাখা হতে শুধু নমিনেশন ফি বাবৎ ১ লাখ আট হাজার টাকা নেওয়া হয়। বাকি একশ শাখা হতে অর্জিত কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করছে কেন্দ্রীয় কমিটি নামধারী জাকারিয়া-আজাদ সিন্ডিকেট।
জিন্দাবাজার শাখার নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় কমিটির শুধু ২০১৫ সালে নমিনেশন ফি বাবৎ ১ লাখ ৮০০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন । গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত ফি অনুযায়ী সভাপতি পদে দু’জনের কাছ থেকে ৭ হাজার টাকা করে ১৪ হাজার টাকা, সহ-সভাপতি পদে তিন জনের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা করে ১৮ হাজার টাকা, সম্পাদক পদে ৩ জনের কাছ থেকে ৬ হাজার ৫ শত টাকা করে ১৯ হাজার ৫ শত টাকা, সহ-সম্পাদক পদে ২ জনের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা করে ১২ হাজার টাকা, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ৩ জনের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা করে ১২ হাজার টাকা , সদস্য পদে ১৩ জনের কাছ থেকে ২ হাজার ৫ শত টাকা করে ৩২ হাজার ৫ শত টাকা সর্ব মোট ১ লাখ ৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়।
তারা জানান, রশিদ বাবৎ প্রতিটি শাখা অফিস হতে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়ে থাকে। এভাবে একশটি শাখা হতে প্রতিমাসে রশিদ বাবৎ লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করা হলেও এর কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। এছাড়া ২৬শ সদস্যের কাছ থেকে প্রতি সদস্য হতে নবায়ন ফি বাবৎ ১২০ টাকা হারে নেওয়া হয় এতে প্রতিবছর আয় হয় ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা । বছরে বিভিন্ন সভা উপলক্ষ্যে ১০০ টি শাখা হইতে চাঁদা বাবৎ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আয় হলেও তা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয় না।
জেলা অটোরিক্শা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় শাখার সভাপতি জাকারিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। বেআইনি কার্যক্রম বন্ধ না করা, গঠনতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা করার অপরাধে গত ২৭ মার্চ জেলা কার্যকরী পরিষদের সভায় উপস্থিতির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা শাখা কমিটিকে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ কারণে তারা অপপ্রচার করছে।
এ বিষয়ে জিন্দাবাজার শাখার সভাপতি সালমান মিয়া বলেন, জাকারিয়া-আজাদ সিন্ডিকেট গঠনতন্ত্রের ৬ (ক) ১১,১৯,২০,২৪, ধারা লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের সাথে স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতারণা, শ্রমিক সংগঠনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বেআইনি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যে গত ৪ মার্চ সিলেট জজ আদালতে একটি স্বত্ব মোকদ্দমা দায়ের করেছি। এছাড়া এসব অভিযোগ তুলে ধরে চট্রগ্রাম শ্রম অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালকের কাছে গত ২২ মার্চ একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
অটোরিক্শা শ্রমিকদের বিরোধ সম্পর্কে সিলেটের সহকারী শ্রম পরিচালক সফিকুর রহমান জানান, এ রকম অভিযোগ শুনেছি। অভিযোগটি চট্রগ্রাম শ্রম অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু সিলেটে শ্রম অধিদপ্তরের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়নি তাই চট্রগ্রাম থেকেই নির্বাচনসহ সব কিছু দেখাশোনা করা হয়।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি প্রকৌশলী এজাজুল হক এজাজ বলেন, জেলা অটোরিক্শা শ্রমিক ইউনিয়নর (৭০৭ )-এর নির্বাচন দীর্ঘ দিন থেকে গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী ও সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হচ্ছে না বলে শুনেছি। সাধারণ সভার মাধ্যমে সভাপতির অনুগতদের মাধ্যমে বর্ধিত সভা করে কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।