প্রাণে-গানে আজ বৈশাখ
ডেস্ক রিপোর্ট :: গাছে গাছে নতুন পাতা। চকচক করছে প্রখর রোদে। বাজারে, দোকানে লাল-সাদা নতুন পোশাকের সমাহার। সিলেট নগরীর পথে পথে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছেন ডুগডুগি, নলখাগড়ার বাঁশি, বাঁশ-বেতের ঝুরি-মোড়া। ওদিকে সিলেট নগরীর ক্বীনব্রিজের নিচ, শ্রীহট্ট কলেজ মাঠ, ব্লু-বার্ড স্কুলের মাঠ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ও এমসি কলেজ ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে রীতিমতো সাজ সাজ রব শুরু হয়েছে আরও আগে থেকেই। যে জন্য এত আয়োজন, আজ সেই নববর্ষ। বাঙালির জীবনের উৎসবের রং ছড়িয়ে এলো পয়লা বৈশাখ। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এসো, হে বৈশাখ এসো, এসো।’
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারা বাংলা আজ ভাসবে বিপুল আনন্দের উচ্ছ্বাসে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়সনির্বিশেষ সব মানুষ শামিল হবেন বৈশাখি উৎসবে। সব ভেদাভেদ ভুলে কায়োমনে বাঙালি হওয়ার প্রেরণায় দীপ্ত বাঙালি বরণ করবে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে।
ঐতিহাসিকদের মতে, বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। সম্রাট আকবর ফসলি সন হিসেবে বৈশাখ মাসকে প্রথম ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। বৈশাখ মাস থেকে বাংলায় প্রথম খাজনা আদায় করা শুরু করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। জমিদারি আমলে পয়লা বৈশাখের প্রধান আয়োজন ছিল খাজনা আদায় উপলক্ষ্যে ‘রাজপুণ্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর ‘রাজপুণ্যাহ’ লুপ্ত হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেনেও আসে পরিবর্তন। হালখাতাও জৌলুশ হারিয়ে ফেলে। ইদানীং নাগরিক জীবনে যে সাংস্কৃতিক চেতনায় পয়লা বৈশাখের উৎসব হচ্ছে, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনিই প্রথম শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবে বৈশাখ বরণের উৎসবের জন্য বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেছেন বহু কালজয়ী সংগীত ও কবিতা। বাঙালির কণ্ঠে আজ ছড়িয়ে যাবে সেই চেনা সুর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…।’
আধুনিক জীবনযাত্রার নানাবিধ প্রয়োজনে সব ক্ষেত্রে বাংলা সনের অনুসরণ এখন আর সম্ভব না হলেও নিজের বর্ষপঞ্জিটি নিয়ে বাঙালির রয়েছে বিশেষ গৌরব। পয়লা বৈশাখ নেহাত একটি বছরের শুরুর দিন নয়, বাংলাভাষীদের কাছে। এটি এই জনপদের মানুষের সুদীর্ঘকালের আপন সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের স্মারক। আপন জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত হওয়ার উৎস। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যবোধে দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষও। এ কারণেই এই উৎসবের গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এবারই প্রথম সরকার চাকরিজীবীদের মুল বেতনের ২০% উৎসব ভাতা দিয়েছে। সরকারের এই নির্দেশনাকে মেনে নিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। এজন্য এবারের বৈশাখের আবহটা চাকুরিজীবীদের মধ্যে অন্যরকম আনন্দ নিয়ে এসছে। বৈশাখ পরিণত হয়েছে বাঙালি জাতির জীবনে এক মহৎ উৎসব হিসেবে।
দিনটি সরকারি ছুটি। তাই ভোর থেকেই আজ সিলেটের পথে পথে ঢল নামবে উৎসবমুখর নগরবাসীর। লাল-সাদা হলো বৈশাখী উৎসবের প্রধান রং। নারীদের পরনে থাকবে সুতির শাড়ি। হাতে কাচের চুড়ি, কবরীতে তাজা ফুলের মালা। পুরুষদের পোশাক হবে রঙিন। প্রধানত পাঞ্জাবি। কেউ যোগ দেবেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়, কেউ যাবেন গান শুনতে। পথের পাশের পসরা থেকে লোকজ খেলনা, কারুপণ্য কেনাকাটা করবেন অনেকে। আবার অনেকে উদ্যানের ছায়ায় বা লেকের পাড়ে বসে মেতে উঠবেন আড্ডায়।
পোশাক-আশাকের মতো আহারেও আজ প্রাধান্য পাবে বাঙালির চিরকালের পছন্দের খাদ্যগুলো। পান্তা, ইলিশ, হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনিতে তৃপ্ত হবে রসনা। আহারে-বিহারে কেটে যাবে বছরের প্রথম দিনটি। তবে এবারের বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া না খাওয়া নিয়ে বেশ বিতর্কও হয়েছে বেশ। অনেকে বলছেন ইলিশ খাবেন আবার অনেকেই বলছেন পান্তা ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। তাই ইলিশ খাবেন না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুম চলছে।
আজকের আয়োজন : মহানগরে আয়োজন : ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় প্রায় তিন দশক ধরে সিলেটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৈশাখি মেলা। কয়েক বছর ধরে সার্বজনীন এই উৎসবের ব্যাপকতা বেড়ে চলেছে। অবশ্য ২০০৫ সালের আগে তিন বছর সিলেটে বৈশাখি মেলা হয়নি। বাংলা ১৪১২ সনে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আবার মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেন। ওই বছর থেকেই নতুন করে বৈশাখি মেলা শুরু হয়।
প্রথমদিকে সংস্কৃতিকর্মীদের সহযোগিতায় সিটি কর্পোরেশন মেলার আয়োজন করলেও পরে এককভাবে সিটি কর্পোরেশন মেলা করে আসছে। প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজের কাছে সুরমা নদীর তীরে সপ্তাহব্যাপী বৈশাখি মেলা বসে। এবার এই মেলার এক দশক পূর্ণ হবে।
বর্ষবরণের কর্মসূচির মধ্যে বৈশাখি মেলা ছাড়াও আনন্দ শোভাযাত্রা, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাউল গান ও পিঠা উৎসব রয়েছে। তবে এবারও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কিন ব্রিজের মোড়ে ১৫ দিনের জন্য মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
সম্মিলিত নাট্যপরিষদের আয়োজনে গতকাল সুরমার পারে চাঁদনিঘাটে ১৪২২ বাংলাকে বিদায় ও ১৪২৩ বাংলাকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করে।
আজ জেলা প্রশাসনের আয়োজনে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা, এমসি কলেজে অনুষ্ঠান, শ্রীহট্ট সাংস্কৃতিক কলেজে বর্ষবরণ করতে নানা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বর্ষবরণের আয়োজনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনও বর্ণাঢ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের উদ্যোগে শোভাযাত্রা ছাড়াও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সাংস্কৃতিক সংগঠন শিকড়, মাভৈঃ আবৃত্তি সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, মিউজিক্যাল সংগঠন রিম, নোঙরসহ বিভিন্ন সংগঠন বর্ষবরণের নিজস্ব কর্মসূচি পালন করবে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য বাংলা নতুন বর্ষ বরণ করতে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রুতি-সিলেট প্রতিবারের মতো এবারও আয়োজন করেছে ‘শ্রুতি শতকন্ঠে বর্ষবরণ উৎসব’-১৪২৩ বাংলা।
অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে চারস্তরের নিরাপত্তা : পয়লা বৈশাখকে ঘিরে সিলেট মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মহানগরে দেড় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য একদিন আগে থেকে মাঠে কাজ করবেন। সব মিলিয়ে চার স্তরের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নির্বিঘœ করতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা থাকবে। শ্রীহট্ট সাংস্কৃতিক কলেজে পুলিশের একাধিক টিম নিরাপত্তায় থাকার পাশাপাশি একদিন আগে থেকেই এ প্রতিষ্ঠানকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনবে পুলিশ। এছাড়াও যে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পয়লা বৈশাখের দিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানেও পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে এমসি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদনিঘাট, কাজী নজরুল ইসলাম অডিটরিয়াম, সিলেট শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
দেড় সহস্রধিক পুলিশের মধ্যে পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে। মোবাইল টিম, পুলিশের নির্ধারিত টিম, টহল টিম, বিশেষ টিম, ডিবি পুলিশের টিম, নগর বিশেষ শাখা, সাদা পোশাকের গোয়েন্দা টিমের সদস্যরা মাঠে থাকবেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, আমরা প্রতিবছরের মতো এবারও বেশ কয়েকটি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। সব আয়োজনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আনন্দ র্যালি ও বৈশাখি মেলা।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, মানুষ যাতে পয়লা বৈশাখ নির্বিঘেœ পালন করতে পারেন সেজন্য আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে দেড় সহ¯্রাধিক পুলিশ পৃথক টিমে কাজ করবে। মাঠে থাকবে পুলিশে গোয়েন্দা টিম। শ্রীহট্ট সাংস্কৃতিক কলেজ থাকবে সিসি ক্যামেরার আওতায়। এছাড়া অনুষ্ঠান হবে এমন সকল স্থানেই পুলিশের টিম থাকবে। তিনি বলেন, বৈশাখি উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে পালনে অপ্রীতিকর সব ধরনের ঘটনা এড়াতে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো, মোটরসাইকেলে দলবদ্ধভাবে হর্ন বাজানো, খোলা ট্রাকে বাদ্য-বাজনা, রং ছিটানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া, যত্রতত্র যানবাহন পার্কিং করা যাবে না। নারী, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে।
বাণী : বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা দেশবাসী ও প্রবাসী বাঙালিদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের কল্যাণময় জীবন কামনা করেছেন।