ঢাকা-যশোর-সিলেটে ১০ সিন্ডিকেট : মানবপাচারে নতুন রুট জর্জিয়া
ডেস্ক রিপোর্টঃ মানবপাচারের নতুন রুট বানিয়েছে শক্তিশালী দালালচক্র। নতুন রুটের জন্য তারা বেছে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ‘জর্জিয়া’কে। দালালচক্রটি বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ই-ভিসার (ইলেকট্রনিক্স ভিসা) সুবিধায় ইউরোপে যেতে আগ্রহীদের প্রথমে জর্জিয়া পাঠায়। এরপর তাদেরকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পাঠানোর জোর চেষ্টা করে এর বিকল্প হিসেবে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চক্রটি। সব কিছুই হয় কন্ট্রাক ভিত্তিতে। বাংলাদেশি দালালচক্রের সঙ্গে তুরস্ক ও জর্জিয়ার কিছু নাগরিক জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে জর্জিয়া পাঠানোর জন্য ঢাকা, যশোর ও সিলেটকেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে জর্জিয়াতে। তুরস্কের আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর এম. আল্লামা সিদ্দিকী ও প্রথম সচিব মো. আরিফুর রহমানের স্বাক্ষরে পাঠানো দুইটি প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রথম সচিবের পাঠানো প্রতিবেদনে ১০ সদস্যের দালাল চক্রের কথা বলা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে- সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ গ্রামের ইসলাম উদ্দিন, যশোরের নোয়াপাড়ার দোপাটি পশ্চিম পাড়ার হালিম হোসেন, সিলেটের স্টেশন রোডের অভি ট্রাভেলসের মালিক অভি (তার সঙ্গে সজীব নামে একজন জড়িত), সিলেটের তাজ ট্রাভেলসের মালিক শরীফ ও আল হারমাইন ট্রাভেলস। এ ছাড়া সিলেটের পাভেল, সোহেল, রনি, ফরিদপুরের মনির (জর্জিয়ার তিবিলিসে বসবাসরত) এবং যশোরের দীপ্ত দালালচক্রের সদস্য হয়ে জর্জিয়াতে মানব পাচার করছেন। প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জর্জিয়া থেকে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যেতে অকাল মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে অনেক বাংলাদেশি জর্জিয়ার জেলখানায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রথম সচিব ও হেড অব চ্যান্সেরির পাঠানো প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, অ্যাম্বাসেডর এম. আল্লামা সিদ্দিকী’র নির্দেশে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা কেমাল ডোগেনকে সঙ্গে নিয়ে ১৪ থেকে ১৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জর্জিয়াতে কনস্যুলার সফর করেন প্রথম সচিব আরিফুর। ওই সফরে তারা দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে যান। প্রথমত- জর্জিয়ার বাটুমি থেকে মো. সজীব হোসেন ও মাহমুদুর রহমান নামে দুই বাংলাদেশির লাশ দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। এ দুই বাংলাদেশির লাশ তাদের পরিবারের খরচে দেশে ফিরবে। দ্বিতীয়ত- জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে ছোট্ট বাংলাদেশি কমিউনিটি পরিদর্শন। কারণ জর্জিয়ার আদালত অনেক বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছেন। এ ছাড়া তিবিলিসির জেলখানায় অনেক বাংলাদেশি বন্দি রয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, কনস্যুলার টীম জর্জিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ১৮ই ফেব্রুয়ারি দুই বাংলাদেশির মৃত দেহ দেশে পাঠায়। মাধ্যম হিসেবে টার্কিশ এয়ারলাইন্সকে ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলাদেশির মৃতদেহ দেশে পাঠানোর পর ১৯শে ফেব্রুয়ারি জর্জিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ডিপার্টমেন্টের পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। পরিচালক তাদের জানান, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে ২০১৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে জর্জিয়া ইলেকট্রনিক ভিসা (ই ভিসা) চালু করেছে। বিদেশে অবস্থিত জর্জিয়া কনস্যুলার অফিসে আবেদন ছাড়া ই- ভিসা পেয়ে যাচ্ছেন। এ তালিকায় বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। আমাদের সরকার দেখেছে, বাংলাদেশি পর্যটক আসার গতি বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্কে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশি। এ কারণে কয়েক মাস আগে জর্জিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশিদের জন্য ই- ভিসার সুবিধায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ওই পরিচালক জানান, বাংলাদেশি নাগরিকদের সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এসব পদক্ষেপের বিকল্প ছিল না। জর্জিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ডিপার্টমেন্টের পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রথম সচিব জেলখানায় যান। সেখানে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত দালালদের মাধ্যমে তারা জর্জিয়াতে এসেছেন। সবাই ই-ভিসা নিয়ে দেশটিতে যান। তাদেরকে বুঝানো হয় জর্জিয়া থেকে তুরস্ক এরপর ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জর্জিয়া থেকে তুরস্ক যাওয়ার সময় তারা জর্জিয়া সীমান্ত পুলিশের হাতে আটক হন। বাংলাদেশিরা জানান, ২০১৫ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জর্জিয়াতে পাঁচ জন বাংলাদেশি মারা যান। কারণ খারাপ আবহাওয়ার দিনে জর্জিয়া থেকে তুরস্ক পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন তারা। ফলে তারা বিপদে পড়েন। জর্জিয়াতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা জানান, কয়েক শত বাংলাদেশি ই- ভিসার সুবিধায় জর্জিয়াতে যান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ হয়ে তারা দেশটিতে পৌঁছান। এরপর তারা অবৈধভাবে তুরস্কে পাড়ি জমিয়েছেন। বাংলাদেশি দালালদের এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে জর্জিয়া ও তুরস্কের কয়েক জন নাগরিক। এর মধ্যেও ৫০ জন বাংলাদেশি জর্জিয়াতে বিপদে পড়েছে। কারণ জর্জিয়া তাদের খরচে কাউকে বহিষ্কার করে না। তাই দণ্ড খাটার পর বাংলাদেশের অর্থেই তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে ই-ভিসার সুবিধা বন্ধ করে দেয়ায় জর্জিয়াতে কোনো বাংলাদেশি যেতে পারছেন না। এদিকে তুরস্কে বসবাসরত বাংলাদেশি অ্যাম্বাসেডর তার চিঠিতে জর্জিয়াতে অবৈধভাবে লোক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত ট্রাভেল এজেন্সি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। পাশাপাশি অবৈধভাবে যাতে কেউ জর্জিয়া না যান ওই বিষয়ে সচেতন করতে মিডিয়াতে বেশি বেশি প্রচারণা চালানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, তুরস্ক হয়ে ইউরোপ যেতে চাইলে মৃত্যু বা জেল ভোগ করতে হবে। এর অন্যথা হবে না। (মানবজমিন)