বাহুবল ট্র্যাজেডি: বাগালসহ ৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট

‘পঞ্চায়েত বিরোধই হত্যার অন্যতম কারণ’

8733_f6ডেস্ক রিপোর্টঃ বত্রিশ কার্যদিবসে বাহুবলের আলোচিত ৪ শিশু হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাগাল তার দুই পুত্র রুবেল ও জুয়েলসহ ৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় তদন্ত কর্মকর্তা, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তাদির হোসেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. কাউসার আলমের আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। ৪২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অভিযোগপত্রে ৯ জনকে অভিযুুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্ত অন্যরা হলো বেলাল মিয়া, সাহেদ, সালেহ আহমেদ, আরজু, উস্তার মিয়া, বাবুল মিয়া ও বাচ্চু। এর মধ্যে বাচ্চু র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আসামিদের মধ্যে জুয়েল মিয়া, রুবেল মিয়া, আরজু মিয়া ও সাহেদ ১৬৪ ধারায় ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। উস্তার মিয়া, বাবুল মিয়া ও বেলাল পলাতক রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত সালেহ আহমেদ ও বশির আহমেদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী কামাল হোসেন বলেন, অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি মোক্তাদির হোসেন তদন্তে সহযোগিতার জন্য তার সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। দুপুরে এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, লাশ উত্তোলনের কাজে জড়িত থাকা লোকজনসহ উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের ৫৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ৩২ কার্যদিবসে ৪২৭ পাতার অভিযোগপত্র তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তারপরও সবার সহযোগিতায় নির্ভুল অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হলে অচিরেই আসামিদের শাস্তি হবে। পলাতক আসামিদেরও ধরতে পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে সিলেটে ডিআইজি মিজানুর রহমান পিপিএমও এ ব্যাপারে প্রেস ব্রিফিং করেন। সেখানে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র উপস্থিত ছিলেন।
পলাতকদের সন্ধানে অভিযান, সাক্ষীদের প্রটেকশনের ব্যবস্থা
সিলেট অফিস জানায়, সুন্দ্রাটিকির চার শিশু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক তিন আসামীকে ধরতে পুলিশের স্পেশাল একটি টিম অভিযানে রয়েছে। আলোচিত এ চার শিশু হত্যা মামলার চার্জশিট প্রদানের পর গতকাল সিলেটে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন ডিআইজি মিজানুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, শুধু ওই তিন আসামিকে গ্রেপ্তারে একটি স্পেশাল টিম কাজ করছে। এর বাইরে মামলা বিচারে ওঠার পর সাক্ষীদের প্রটেকশনে পুলিশের আরও একটি টিম কাজ করবে। সে ব্যবস্থা ইতিমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি বলেন, আব্দুল আলী বাগালের ছেলে বিল্লাল মিয়া, আব্দুর বারিকের ছেলে উস্তার মিয়া ও বাবুল মিয়া পলাতক রয়েছে। ঘটনার পর থেকে পুলিশ তাদের অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাদের এলাকায় পাওয়া যায়নি। এ কারণে তিনজনকে পলাতক রেখেই দ্রুত বিচারের স্বার্থে মামলার চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। তবে, পলাতক থাকা তিন আসামি দেশের অভ্যন্তরেই রয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, ওরা নিতান্তই দিনমজুর। পাশাপাশি পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার আগে থেকেই তারা গা ঢাকা দেয়। আর এখন তারা মোবাইল ফোনও ব্যবহার করছে না। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান চালিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে, পুলিশ অনুসন্ধানে রয়েছে। ধরা পড়া মাত্রই তাদের আদালতে হাজির করা হবে। কী কারণে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড? প্রশ্ন করা হলে ডিআইজি বলেন, গ্রাম্য পঞ্চায়েত নিয়ে বিরোধই চার শিশু খুনের অন্যতম কারণ। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের পঞ্চায়েতের দলাদলি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বিরোধ চলছিল। গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে ওই বিরোধ আরও তীব্র হয়। আর এ কারণেই বাগাল ও তার লোকজনের হাতে নিহত হতে হয়েছে চার শিশুকে। আদালতে দেওয়া চার্জশিটে ন্যায় বিচার কতটুকু নিশ্চিত হবে- এ প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, শত ভাগ ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। মামলা বিচারাধীন অবস্থায়ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশ আদালতকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে বলে জানান তিনি। এদিকে, র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আব্দুল বারিকের ছেলে বাচ্চু মিয়াকে চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে। তবে, ডিআইজি তার বক্তব্যে সে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, বাচ্চু মিয়া আলোচিত চার শিশু হত্যা মামলার অভিযুক্ত আসামি। সে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে আসামি হলেও ক্রসফায়ারে ইতিমধ্যে মারা গেছে। এ কারণে আসামির তালিকায় তার নাম রাখা হলেও মারা যাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এখন ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলবে। ডিআইজি বলেন, আলোচিত এ ঘটনায় চার্জশিট আদালতে দাখিল হওয়ার আগেই ইতিমধ্যে চার আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তার জবানবন্দি থেকে ঘটনার অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তাদের বক্তব্য ও আসামিদের জবানবন্দি পর্যালোচনা, সাক্ষীদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা তদন্ত করেই এ রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত করতে আন্তরিক রয়েছে। এ কারণে খুব দ্রুত চার্জ গঠনের মাধ্যমে আলোচিত এ মামলাটি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সমাপ্তি হবে। এবং আলোচিত এ ঘটনার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কারণেই পুলিশ আসামিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিক/০৩) এর ৭/৩০ ধারাসহ পেনাল কোড-৩০২/২০১/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৮ জনকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মো. ওয়াহিদ মিয়ার পুত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাত ভাই আবদুল আজিজের পুত্র তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার পুত্র মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আবদুল কাদিরের পুত্র ইসমাঈল হোসেন (১০) নিখোঁজ হয়। ওই দিন বিকাল বেলা তারা উত্তর ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে পরদিন ওয়াহিদ মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাতে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দায়ের করেন নিখোঁজ এক শিশুর পিতা। এ ঘটনার পর পুলিশের একাধিক টিম ও র‌্যাব মাঠে নামে ওই শিশুদের অনুসন্ধানে। ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিকালে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ শিশুদের সন্ধানদাতাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে নিখোঁজ শিশু মনির মিয়ার পিতা আবদাল মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকালে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের দিনমজুর কাজল মিয়া প্রতিদিনের ন্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে করাঙ্গী নদীর পাশে মাটি কাটতে গিয়ে মাটিচাপা অবস্থায় ৪ শিশুর লাশ দেখতে পান। পরে লাশগুলো উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত শেষে ওই দিন রাতে দাফন করা হয়। (মানবজমিন)