ছাত্রনেতারা পদের মূল্যায়ন করতে পারে না, দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে যায় -একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ উদ্দিন আহমদ
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ। এককালে ছিলেন সিলেট ছাত্রলীগের সভাপতি। নগরীর মিরবক্সটোলার মরহুম আব্বাস আলী ও নূরুজ্জাহান আব্বাসের চতুর্থ পুত্র তিনি। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে সিলেটে যাদের সুনাম রয়েছে, তিনি তাদের একজন। সম্প্রতি মিরবক্সটোলার বাসায় তিনি মুখোমুখি হন দৈনিক সবুজ সিলেটের।
কথা বলেন, শিক্ষা, বিয়ে-সংসার, রাজনীতি এবং সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে। গল্পের ফাঁকে ওঠে আসে কীভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে সম্মানীয়, কীভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ ধারণ ও লালন করছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। সিলেটের রাজনীতির জানা-অজানা অনেক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল হক শিপু।
কোন শিক্ষায় অনুপ্রাণিত-এ প্রশ্নের জবাবে আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু হয় সিলেট সরকারি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে। এখান থেকে এসএসসি পাস করার পর এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি (বি.কম) পাস করেন মদনমোহন কলেজ থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শের শিক্ষা প্রাথমিকভাবে তাঁর পরিবারের কাছ থেকেই লাভ করেন। তাঁর পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বড় তিন ভাই দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা এবং হৃদয়ে জাতীয় সংগীত লালন ও ধারণ করার শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। যে শিক্ষা তাঁর সারা জীবন পথ চলার পাথেয় হয়ে থাকবে। সেই শিক্ষা একজন প্রকৃত দেশপ্রেমী হওয়ার শিক্ষা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার শিক্ষা।
আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, পারিবারিকভাইে তিনি রাজনীতিতে আসেন। তাঁর বড় তিন ভাই ছাত্রলীগের রাজনীতি করে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে সিলেটে ৩ জন গ্রেপ্তার হন। এদের একজন ছিলেন তাঁর বড় ভাই আতাউর রহমান। দ্বিতীয় ভাই মাসুক উদ্দিন ও তৃতীয় ভাই বদর উদ্দিন আহমদ তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তাদের আদর্শই তাঁকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়াতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭৭ সালে তিনি মদনমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। ছাত্রছাত্রীদের ভোটে ১৯৭৮ সালে প্রথমেই খেলাধুলা সম্পাদক, ১৯৭৯ সালে ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক, ১৯৮০ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮২ সালে সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্রসংসদের অন্যতম নেতা হিসেবে তাঁর উপর কারণে-অকারণে ১৯টি মামলা দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি খন্দকার মোশতাক সিলেটে একটি জনসভা করেন। ওই জনসভার মঞ্চ আসাদের নেতৃত্বে ভেঙে ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই সভাস্থলে আসাদ উদ্দিনের পরিচালনায় ছাত্রসংসদ প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পরে মোশতাক পুলিশ ও বিডিআরের পাহারায় সিলেট ছাড়তে বাধ্য হয়। এভাবেই তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আসেন। ১৯৯১ সালে প্রথম জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ২০০৩ সালে মহানগর গঠনের পরই মহানগর আওয়ামী লীগের ১ম যুগ্ম সম্পাদক এবং ২০১১ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
নিজের পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁর বড় ভাই আতাউর রহমান স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর এপিএস ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ১৯৭৫ সালের পর তিনি বিদেশি একটি কোম্পানিতে চাকরিতে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। দ্বিতীয় ভাই মাসুক উদ্দিন আহমদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর ছেলে তামিম আহমদ অমি যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের সভাপতি। তৃতীয় ভাই বদর উদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক সৈনিক। তিনি সিলেট জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী তিনি। তাঁদের একমাত্র বোন শাহেদা আক্তার সবার ছোট। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে যুক্তরাজ্য বসবাস করছেন।
বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর দুটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে হলে নির্দিষ্ট ইস্যুর প্রয়োজন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নেতৃত্ব বেরিয়ে এসেছিল। তারা দেশের জন্য আন্দোলন করে নেতা হয়েছিলেন। এরশাদের শাসনকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। বর্তমানে দেশ শান্ত; আন্দোলনের সুযোগ নেই; তাই নেতৃত্বও বেরিয়ে আসছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করি, তখন অনেক কষ্ট করে ভোটের মাধ্যমে ছাত্রনেতার খ্যাতি পেয়েছি। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজের ভালো ইমেজ তুলে ধরেছি। এরপর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমাদেরকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছে। আর এখন ভোটাভোটি নেই; নেতা হতে কোনো প্রতিযোগিতার প্রয়োজন হয় না। ছাত্রনেতারা বিনাপরিশ্রমে নেতা হয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে তারা নিজেদের পদের মর্যাদা দিতে পারছেন না। যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদের ভোটে তারা ছাত্রনেতা হতেন, তাহলে অবশ্যই নিজের পদের মূল্যায়ন করতে পারতেন। আসাদ উদ্দিন বলেন, ছাত্ররাজনীতি সুন্দর ও গণতান্ত্রিকভাবে চালাতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। কষ্টে অর্জিত ধন; সব সময় মূল্যবান।’
ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগের কারণ জানতে চাইলে আসাদ উদ্দিন বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তারা পদ পাওয়ার পর পদের মূল্যায়ন করতে পারে না; দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদকে পূঁজি না করে ছাত্রনেতাদের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তাদেরকে সঠিক পথে আনার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কলেজ, জেলা, উপজেলা, থানা ও পৌরসভা পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্বে আনা। কারো ভোট পেতে হলে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে ভোট আনতে হয়; ভালো ব্যবহার করতে হয়। ভালো ব্যবহার ও কাজ করলে তখনই হৃদয়ে ভালো কিছু করতে ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হয়।’
আগামীতে গণপ্রতিনিধি বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার আশা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করলে সবাই গণপ্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধি হতে চায়। আমার রাজনীতির মূল লক্ষ্য, মানুষের সেবা করা। মানুষের একদম পাশে থেকে সেবা করার সুযোগ পান গণপ্রতিনিধিরা। তবে রাজনীতি করলে অনেক সময় অনেক কিছু চাইলেও পাওয়া যায় না। অনেক সময় পরিস্থিতির উপর অনেক বিষয় নির্ভর করে। সময়ই বলে দেবে কখন কী করতে হবে।’
তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনার বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, ‘বি.কম শেষ করার পর ভর্তি হই সিলেট ল’ কলেজে। স্বপ্ন ছিল একজন আইনজীবী হওয়ার। তখন বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। আমি তখন সিলেটে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে খুব সক্রিয় ছিলাম। যখন ল’ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করব, ঠিক সেই সময় আমার ভাগ্যে আন্দোলন কাল হয়েছিল। ফরম পূরণের দিন আমি ল’ কলেজে। কে পুলিশ বাহিনীকে বলে দিল আমি কলেজে আছি। এরশাদ সরকার তখন ক্ষমতায়। এর কিছুক্ষণ পরই পুরো ক্যাম্পাসের চারিদিক ঘেরাও করে ফেলল পুলিশের লোকজন। আমি কোনোভাবে ক্যাম্পাসের পেছন দিয়ে দৌড়ে পালাই। তাই আর ফরম পূরণ করা হলো না। আর আমিও আইনজীবী হতে পারলাম না। এটি আমার জীবনে সবচেয়ে বড় বেদনার স্মৃতি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে আসাদ উদ্দিন বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সুন্দর সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। যে বাংলাদেশে থাকবে না অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস। চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সোনার বাংলাদেশ। আর সেই বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশের সফল প্রধানমন্ত্রী, দেশরতœ শেখ হাসিনা। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবদিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কাক্সিক্ষত ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পথেও এগিয়ে যাচ্ছি। শেখ হাসিনার হাত যেখানেই লাগছে, সেখানেই সোনা ফলছে। বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ দেশ হবে এই প্রত্যাশা নিয়েই বঙ্গবন্ধু কন্যা দিনরাত কাজ করছেন।’
আসাদ উদ্দিন আহমদ এক ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক। বড় ছেলে রাসাদ উদ্দিন আহমদ বিবিএ পড়ছে। আর মেয়ে রেজওয়ানা আফরিন হৃদি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আসাদ উদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।