মুহিতের বক্তব্যে দলের ভেতরে ক্ষোভ, প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট
ডেস্ক রিপোর্ট :: একটি বাংলা দৈনিকে পদত্যাগী গভর্নর আতিউর রহমানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক সভায় দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীসহ নেতৃবৃন্দ উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে রোববার সন্ধ্যায় দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির পর মন্ত্রী মুহিত গত শুক্রবার বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিদায়ী গভর্নরের সমালোচনা করেন।
সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সংবাদ সম্মেলনই করেছেন। বাড়িতে করেছেন এবং দুই দফা। একবার পদত্যাগের আগে,আরেকবার পদত্যাগের পর। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলেছেন। দুজন ডেপুটি গভর্নরের চাকরি গেছে তার কারণে। বোঝাতে চাইলেন যে তিনি একা দায়ী নন। দুজনের বাইরে আরও কয়েকজনের চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তা আর হয়নি, হবেও না।”
সাবেক গভর্নরের অবদান ‘প্রায় শূন্য’ মন্তব্য করে মুহিত সাক্ষাৎকারে আরও বলেন,“তিনি (আতিউর রহমান) খালি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লোকজনকে অনুরোধ করেছেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাকে সুযোগ দিতে ও দাওয়াত দিতে। এখন বেরোচ্ছে এগুলো।”
সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর মন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, তার চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়াই প্রথম আলো কথাগুলো প্রকাশ করেছে এবং এসব বক্তব্য তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাসহ সরকারি দলের নানা স্তরের নেতারা প্রায়ই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে থাকেন। রোববার দলের বৈঠকে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা উঠলে প্রধানমন্ত্রীও অশীতিপর মন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নেতা।
বিষয়টি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কোনো নেতা প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুহিতের এই বৈঠকে উপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী সংসদের বেশ কয়েকজন সদস্য কথা বলেছেন।
নব্বই পরবর্তী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা দলীয় সভানেত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিটিংয়ে অর্থমন্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুরো হাউজই অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে এক সুরে কথা বলেছেন।” কার্যনির্বাহী সংসদের একাধিক সদস্যের বরাতে জানা গেছে বিস্তারিত।
তারা জানান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। হাছান মাহমুদ এই ঘটনার জন্য আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংককে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন। এসময় হাছান মাহমুদের বক্তব্যের ভুল ধরে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, “হাছান, তুমি ভুল বলছো।”
এরপর জাফরউল্যাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও লেনদেনের পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং দলের কোষাধ্যক্ষ ও মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ এন আশিকুর রহমানও কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, গভর্নরের পদত্যাগের পরও তাকে নিয়ে মন্ত্রীর এইরকম প্রকাশ্য বক্তব্য তার বোধগম্য নয়। আতিউর রহমানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের’ বিষয়টি এভাবে পত্রিকায় না নিয়ে এলেই অর্থমন্ত্রী ভালো করতেন বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদায়ী গভর্নরের প্রশংসাও প্রধানমন্ত্রী করেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকরা জানান।
“প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, ‘আমি পদ্মা ব্রিজের সময় অর্থমন্ত্রীর কাছে টাকা চেয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, ‘আমি কোথা থেকে টাকা দেবো?’ সেই টাকার ব্যবস্থা আতিউরই করে দিয়েছিল’।”
বৈঠকে সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রীদের ‘লাগামছাড়া’ বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্যের সমালোচনা করে নাসিম বলেন, “মন্ত্রীরা এভাবে কথা বললে সরকারের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে।”
যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায়ের আগে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানির দাবি তোলেন কামরুল।
এসব আলোচনার পর আবার গভর্নর নিয়ে আলোচনা উঠে। তাকে নিয়ে ফেইসবুকে দেওয়া দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনের বক্তব্যের বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। ফেইসবুকে দেওয়া নিজের স্ট্যাটাস এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে লেনিন বলেন, তার এই স্ট্যাটাস ও বক্তব্য দেওয়া ‘ঠিক হয় নাই’। রোববারের এই বৈঠকে ১০ ও ১১ জুলাই হতে যাওয়া আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের বিষয়েও আলোচনা হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে দলের সকল সাংগঠনিক জেলা কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।