তত্ত্ব ও বাস্তবের ফারাক অনেক

5ডেস্ক রিপোর্ট :: বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ হতাশাই ব্যক্ত করলেন। প্রায় দুই বছরেরও অধিক সময় পর জামিনে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছিল, তা আর ধরে রাখা গেল না। একানব্বই সালের নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে সত্য, কিন্তু ভেতর থেকে দলটি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর বিএনপিকে তো ক্ষমতাসীনরাই দুর্বল করে দিচ্ছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক ধরনের অশনি সংকেত।

কিন্তু ড. মোশাররফের এ হতাশার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণায় যা পাওয়া যায়, তার সাদৃশ্য খুব কম। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান তার বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত এক গবেষণায় মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। পাশ্চাত্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রমাণিত হয়েছে যে, দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে সেদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বরং এই দ্বিদলীয় ব্যবস্থা রাজনৈতিক মারামারি, দলাদলি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এমনকি এ ব্যবস্থা এক ধরনের অন্তহীন সমস্যার মনোভাব তৈরি করেছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

রওনক জাহান বলেছেন যে, সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, নিয়মিতভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার হাত বদল হলে তা সময়ের ব্যবধানে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে সহায়তা করে। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীতটাই বরং প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তখন থেকে অর্থাৎ ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও এবং প্রতিটি নির্বাচনে সংসদীয় বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার পরও দেশের দুটি মূল দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে মৌলিক নিয়মনীতির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি।

রাজনৈতিক উন্নয়নের অন্য এটি তত্ত্ব হচ্ছে, নিয়মিত বিরতিতে নির্বাচন এবং ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে রাজপথে যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়, তার প্রয়োজন আর থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে একানব্বই সালের পর থেকে চারটি নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হাত বদল হলেও রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম তো শেষ হয়ে যায়নি। বরং যে দল বিরোধী দলে থাকে, দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীন দলকে চাপে রাখতে রাজপথের আন্দোলন প্রধান হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার এমন আপাত-বিরোধী আচরণ কেন হচ্ছে, তার সঠিক কারণ অনুসন্ধানে এখনো তেমন কোনো গবেষণা হয়নি বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান। প্রশ্ন হচ্ছে গবেষণা হলেও সেই গবেষণা কী কাজে লাগে আমাদের?

এ দেশের রাজনীতির আরেকজন বিদগ্ধ গবেষক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান একবার আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন যে, এ দেশে কোনো গবেষণা কাজে লাগে না। কেননা, গবেষণা বাস্তবায়নের জন্য যে ন্যূনতম শর্তাদি পূরণ করতে হয়, তা পূরণ হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথাই যদি ধরি তাহলে কী দেখছি আমরা? দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের পর এ ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ করা হয় এবং এর অধীনে প্রায় ৪টি নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এরপরই বিভিন্ন অভিযোগে ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দেওয়া হলো। ব্যবস্থার দোষত্রুটি থাকতে পারে এবং প্রয়োজনে সেই দোষত্রুটি মুক্ত করে ব্যবস্থাটিকে আরও পাকাপোক্ত করা যেত। কিন্তু তা না করে কোনো ঐকমত্য ছাড়াই আমরা তা বাতিল করে দিলাম।

এর বিপরীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যারা পুনঃপ্রবর্তন করতে চান সেই অংশ বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটও আন্দোলন-সংগ্রামে বিবেচনার পরিচয় দিতে পারেনি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিহীন দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারত। অনুমান করা হয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট সেই নির্বাচনে অংশ নিলে সরকার গঠন করার মতো সংসদীয় আসন না পেলেও ভালো একটি অবস্থান নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসন পেতে পারত। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি নিয়ে আরো জোরালোভাবে আন্দোলন করতে পারত। কিন্তু তা না করে তারা নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের কর্মসূচি দিল। কিন্তু যা হবার তাই হলো। কিছুই করতে পারল না। বরং নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হলো বেশি।

এরপর বিএনপি আরও যে ভুলটি করল তা হলো ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিনকে গণতন্ত্রের জন্য কালো দিবস আখ্যায়িত করে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। এতে বিএনপির কোনো লাভ হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন না। বরং ক্ষতিই হয়েছে বেশি এজন্য যে, এ আন্দোলন-সংগ্রামে সারা দেশে যে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে তার পুরো দায়ভারই বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। যদিও বিএনপি দাবি করে আসছে যে, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার ক্ষমতাসীন দলের।

আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিতে এমন ব্লেমগেম দেখছি আমরা। কিন্তু এতে তো আমাদের কারও লাভ হচ্ছে না। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এখানে শুরু হলেও এ ব্যবস্থার যে সুযোগ-সুবিধা তা আমরা ভোগ করতে পারছি না। তাই ড. রওনক জাহান বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি লালন পালন করতে হবে তেমনি দলের অভ্যন্তরেও করতে হবে গণতন্ত্রের চর্চা। তবেই এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।