সরকারি নীতিমালা ও হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা-স্টোনক্রাশার মেশিনে পাঁচ উপজেলায় পরিবেশ বিপন্ন
মো.ফখরুল ইসলাম :: হাইকোর্টের নির্দেশ উপক্ষো করে সিলেটের পাঁচ উপজেলায় অবাধে চলছে স্টোনক্রাশার মেশিন। জেলার বিভিন্ন স্থানে লাইসেন্সবিহীন ও পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধ এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠেছে স্টোনক্রাশার মিল। সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে শহরতলি ও পার্শ¦বর্তী ৫টি উপজেলায় স্টোনক্রাশার মিল গড়ে উঠার ফলে এসব স্থানে পরিবেশদূষণ, যান চলাচলে বিঘœ ঘটাসহ জনদুর্ভোগ বেড়েছে। আর এতে ফায়দা হাসিল করছে স্থানীয় সন্ত্রাসী, পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
স্টোনক্রাশার মেশিন স্থাপনের নীতিমালায় উল্লেখ আছে, লাইসেন্স ব্যতিরেকে কোনো স্টোনক্রাশার মেশিন স্থাপন করা যাবে না। শহর, উপজেলা সদর, পৌরসভা এবং গ্রোথ সেন্টার এলাকায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বসতবাড়ি, প্রধান সড়ক এবং মহাসড়কের ৫০০ মিটারের মধ্যে স্টোনক্রাশার মেশিন স্থাপন করা যাবে না।
কিন্তু সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে শহরতলির ধোপাগুলে ওসমানী বিমানবন্দরের দেয়ালের সাথেই বসানো হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক স্টোনক্রাশার মেশিন। ধোপাগুল জামে মসজিদ, উমদারপাড়া ,ও ধোপাগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই আরো বেশ কয়েকটি স্টোনক্রাশার মিল রয়েছে । এসব স্টোনক্রাশার মিলের ঘড়ঘড় শব্দে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে ঠিকমতো পাঠ গ্রহণ করতে পারে না বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
স্টোনক্রাশার মেশিন স্থাপনের নীতিমালায় উল্লেখ আছে,স্টোনক্রাশার মেশিন পরিচালনাকালে উদ্ভূত শব্দমাত্রা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬-এ বর্ণিত মানের মধ্যে থাকতে হবে। এছাড়া স্টোনক্রাশিংয়ের ফলে নির্গত ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাস্ট ট্রেপিং ডিভাইস স্থাপন করা এবং ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনমতো পানি ছিটাতে হবে। কিন্তু এ সব নিয়মের মেনে চলেন না ধোপাগুল স্টোনক্রাশার ব্যবসায়ীরা।
এদিকে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ের আশপাশে পরিবেশ অধিফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে উঠেছে পাথর ভাঙার অসংখ্য স্টোনক্রাশার মিল। এগুলোর বেশিরভাগই অবৈধ। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র তো নেই-ই, সরকারি জমি এমনকি গাছ ও টিলা কেটেও গড়ে তোলা হয়েছে এসব মিল। এসব মেশিনের শব্দ ও ধুলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এলাকার পরিবেশ। আর পর্যটক হারাচ্ছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাফলং এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক ক্রাশার মিল। বৈধভাবে গড়ে ওঠা মিল রয়েছে আরো দুইশর মতো। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যৌথ বাহিনী জাফলংয়ে অভিযান চালিয়ে ৩৬টি ক্রাশার মেশিন গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই আবার শুরু হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে স্টোনক্রাশার মেশিন স্থাপন। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব মিল স্থাপন করেছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্টোনক্রাশার মিলের ধুলাবালির কারণে দিনের বেলাও পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে থাকে। সড়ক দিয়ে হেঁটে চলাচলের উপায় থাকে না। ক্রাশার মেশিনের কারণে শব্দদূষণও ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। স্টোনক্রাশার মেশিনগুলো খোলা স্থানে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করায় এবং ধুলা নিরোধক ব্যবস্থা না থাকায় উল্লিখিত এলাকাগুলো ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এসব ধুলাবালিতে মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র নষ্ট এবং পানিও দূষিত হচ্ছে। সেইসাথে পাথর ভাঙা মেশিনের ধোঁয়া, পাথরের গুঁড়া মিশ্রিত হওয়া বাতাস এবং শব্দদূষণ পরিবেশ বিনষ্ট করছে। ওইসব এলাকার মহাসড়ক, জনবসতি, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, বাজার, সরকারি ও বেসরকারি অফিস সংলগ্ন এলাকা, জাফলং পর্যটন এলাকা এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও স্টোনক্রাশার মেশিন চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট-তামাবিল সড়কের জাফলংয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সড়কের দু’পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্টোন ক্রাশার মিল। বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে বন বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের জমি দখল করে। স্টোন ক্রাশার মিল স্থাপনের জন্য সাবাড় করে ফেলা হয়েছে বনের গাছপালা। এছাড়া সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের দু’পাশের সবক’টি ড্রেন ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে মহাসড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে বিটুমিন উঠে গিয়ে সড়কে মারাত্মক গর্ত ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। একারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তামাবিল ও জাফলং থেকে আসা কয়লা ও পাথরবাহী এবং পর্যটকবহনকারী যানবাহন।
বন বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের মধ্যে বনের জমি সবচেয়ে বেশি বেদখল হয়েছে গোয়াইনঘাটে। এ উপজেলায় বন বিভাগের ২২ হাজার ২০৭ একর জায়গার মধ্যে ২০ হাজার ১৭২ একরই বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে স্টোন ক্রাশার মিল, ডাম্পিং ইয়ার্ড ও আবাসন।
ধোপাগুল এলাকার আলী আসকর জানান, এই এলাকায় প্রথমে দুইটি পাথর মিল ছিল। বিগত বছর ও চলতি বছরে এর সংখ্যা শতাধিক হয়েছে। এই মিল মালিকদের কাছ থেকে নিয়মিত পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরের লোকজন মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকায় সুরমার পারে স্থানীয় লোকদের সম্পৃক্ত করে ভোলাগঞ্জের কিছু পাথর ব্যবসায়ী এখানে পাথর মিল বসিয়েছেন। এখানে রয়েছে ১২টি পাথর মিল। অপরদিকে শাহপরান থানার মিরেরচক এলাকায় সুরমার তীরে আরো দুটি পাথর মিল বসানো হয়েছে। এভাবে সরকারি ছাড়পত্রবিহীন পাথর ভাঙার মিলের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সিলেট স্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোবাশ্বির আহমদ কয়েস জানান, তাদের সংগঠনের অধীনে থাকা বেশিরভাগ মিলেরই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র রয়েছে। কিন্তু ছোট ক্রাশার মেশিনগুলো (টমটম) কোনো ধরনের ছাড়পত্র ছাড়াই যত্রতত্র স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, অবৈধ ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ ও জব্দের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকবার পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
একাধিক পাথর ব্যবসায়ীর কাছে ছাড়পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ছাড়পত্র কারো নেই। প্রশাসনের সঙ্গে মৌখিকভাবে সম্পর্ক রেখে পাথর মিলগুলো চলছে।
অবৈধভাবে পরিচালিত সকল স্টোন ক্রাশার মেশিনের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) গত বছরের মাঝামাঝিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন (রিট পিটিশন নম্বর ৭৫৫২/২০১৫) করে। বিভিন্ন স্থানে অবৈধ এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত স্টোন ক্রাশার মেশিনের কার্যক্রম বন্ধ করতে এবং যথাযথ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য স্থানে স্টোন জোন করে পাথর ক্রাশার মিল স্থানান্তর করতে রিটে আবেদন জানানো হয় ।
মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে গত বছরের ৩ আগস্ট আদালত অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত এবং অননুমোদিতভাবে স্থাপিত ও পরিচালিত স্টোন ক্রাশার মেশিনকে কেন আইন বর্হিভূত ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বিবাদিদের উপর হাইকোটের্র একটি বেঞ্চ রুলনিশি জারি করেন। এ রুলের জবাব না দেওয়ায় এবং মেশিনগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম এবং বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ গত ২৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ রায় প্রদান করেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক, সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেলা’র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ধোপাগুল ও জাফলং এলাকায় পাথরকেন্দ্রিক পরিবেশ বিনষ্টের মহড়া চলছে। পরিবেশ নীতিমালা অনুসরণ না করেই সিলেটের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে অবৈধ স্টোনক্রাশার মিল। এসব অবৈধ স্টোনক্রাশার মিল চলে প্রশাসনের সাথে বুঝাপড়ার মাধ্যমে। অবৈধ স্টোনক্রাশার মিল বন্ধে হাইকোর্টর নির্দেশনা সত্ত্বেও পাথর ব্যবসায়ীরা তা অনুসরণ করছেন না । এতে পাথর ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি প্রশাসনও দায়ী।
এ ব্যাপারে ধোপাগুল পাথর মালিক সমিতির সহসভাপতি সালেহ আহমদ শাহনাজ জানান, স্টোন ক্রাসার ব্যবসায়ীরা পরিবেশ রক্ষা করে ব্যবসা পরিচালনা করতে একমত। একটি স্টোন ক্রাশার জোন নির্মাণের দাবিতে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। আমরা হাইকোর্টে রিট করে স্টোন জোন নির্মাণ ও সময় চেয়ে আবেদন করব ।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনির হুসেন জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গায় কোথাও যদি স্টোন ক্রাসার মিল গড়ে উঠে তবে এগুলো জেলা প্রশাসন দেখবে। অবৈধ স্টোন ক্রাশার মিল উচ্ছেদে শীঘ্রই জেলা প্রশাসন নিয়ে অভিযান পরিচালনা করব।
সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মো. মাহবুবুর রহমান জানান, গত ১০ মার্চের জেলা আইনশৃঙখলা মিটিংয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই টাস্কফোর্সের মাধ্যমে এসব অবৈধ স্টোন ক্রাশার মিল শীঘ্রই উচ্ছেদ করা হবে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.সালা উদ্দিন জানান, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে অবৈধ ক্রাশার মেশিন বন্ধের জন্য নোটিস করা হয়েছে। শীঘ্রই এসব উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সালাউদ্দিন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সাহেদা আক্তার জানান, এসব অবৈধ স্টোন ক্রাসার মিল বন্ধ করা জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে অবৈধ স্টোন ক্রাশার মিল চালানো আদালত অবমাননার শামিল। অনতি বিলম্বে এ সব অবৈধ স্টোন ক্রাসার মিল উচ্ছেদ করে পরিবেশ সম্মত স্টোন ক্রাসার জোন স্থাপন করে নিরাপত্তার হুমকি থেকে সিলেটবাসীকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদিন জানান, অবৈধ স্টোন ক্রাসার মিল উচ্ছেদের জন্য ৫টি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দু একটি উচ্ছেদও করা হয়েছে। আর পরিবেশসম্মত স্টোন জোন নির্মাণের জন্য ডিভির হাওরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।