রাগীব আলী ও সহযোগীদের সাজা হতে পারে ১৪ বছর

Kabir-Sylhet-1ডেস্ক রিপোর্ট :: সিলেটের ‘দানবীর’ নামধারী রাগীর আলী ও তার সহযোগীদের সাজা হতে পারে ১৪ বছর। জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি অভিযোগই ছিল সরকারের ভূমি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তার। পরে দুটি অভিযোগই উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি আর এগুতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মামলা দুটি সচল করার নির্দেশ দেন।

আইনজ্ঞরা বলছেন, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে অভিযুক্তদের। সাবেক পিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, স্বাক্ষর জাল, জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হওয়ার বিধান রয়েছে। রাগীব আলীসহ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ এ দুটি অভিযোগ করেছিলেন এসএম আবদুল কাদের। সিলেট সদরের ভূমি কমিশনার থাকাবস্থায় ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ও ২ নভেম্বর তিনি দুটি অভিযোগ করেন। বর্তমানে এ কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

সিলেট কোতোয়ালি থানায় এজাহার দায়েরের সময় সরকারি দফতরের স্মারক জাল করে ভুয়া চিঠি সৃজনসহ জালিয়াতির ৪টি প্রমাণপত্রও জমা দেন মামলার বাদী। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকণ্ঠচন্দ্র গুপ্ত পিতা মৃত লালচন্দ্র গুপ্ত তারাপুর চা বাগানসহ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতার নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র করে একটি দলিল সম্পাদন করেন। তখন থেকে সম্পত্তিটি দেবোত্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে নানা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রাগীব আলীর পুত্র আবদুল হাইয়ের নামে ৯৯ বছরের বন্দোবস্তের দলিল সৃজন করা হয়। দলিলে স্বাক্ষর করেন রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জনৈক দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। অভিযুক্ত রাগীব আলী ও তার সহযোগী জালিয়াত চক্রের দাবি-শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ দেবতার পক্ষে সেবাইত শ্রী পংকজ কুমার গুপ্ত ১৯৮৮ সালে ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জমি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে রাগীব আলীর পুত্র আবদুল হাইয়ের কাছে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে চুক্তিতে আবদ্ধ হন।

অথচ সেবায়েত নিজে উক্ত দলিলে স্বাক্ষরই করেননি! তার দ্বারা প্রদত্ত বলে কথিত আমমোক্তারনামা রাগীব আলীর আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদের মাধ্যমে উক্ত দলিল সম্পাদন করেন। এতে আমমোক্তার নিয়োগ করা হয় রাগীব আলীর স্ত্রী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, রাগীব আলীর আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর মেয়ে জামাই আবদুল কাদির ও রাগীব আলীর মেয়ে রোজিনা কাদির। এ চারজনই রাগীব আলীর পারিবারিক সদস্য ও নিকটাত্মীয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাগীব আলীই তার নিজের স্বার্থে জাল আমমোক্তারনামা তৈরি করেছেন। এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে রাগীব আলী, পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, আবদুল হাই, আবদুল কাদির ও রোজিনা কাদিরকে।

অপরদিকে তারাপুর চা বাগানটি রাগীব আলীর অবৈধ দখল ও আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন পেশ করেন মো. লাবলু মিয়া, হিরণ মিয়া, বশির আহমদ এবং হাশিম মিয়া। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মন্ত্রণালয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি তারাপুর চা বাগান নিয়ে নানা রকম অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেন এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেন। এরপর ২০০৫ সালের ২০ আগস্ট সিলেটের জেলা প্রশাসকের দফতরে কথিত একটি চিঠি আসে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূম/শা-৮/খাজব/৩৯৯/৯১/১৭০ স্মারকের ওই চিঠিতে অভিযোগকারী মো. লাবলু মিয়া, হিরণ মিয়া, বশির আহমদ এবং হাশিম মিয়ার আবেদনটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং সিলেটের অতিরিক্ত কমিশনারের প্রতিবেদনটি অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করা হয়।

ওই চিঠির সেঙ্গ আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কথিত মতামতের একটি ফটোকপি সংযুক্ত করে তারাপুর চা বাগানের সম্পত্তির নামজারি করে দিতেও বলা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কথিত চিঠির স্বাক্ষরকারী সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হক। কিন্তু স্বাক্ষরের অসামঞ্জস্য দেখে সন্দেহ জাগে সিলেটের জেলা প্রশাসকের। ফলে ওই চিঠির সত্যতা যাচাই করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখেন তিনি। যাচাইয়ের পর ভূমি মন্ত্রণালয় জানায় ওই চিঠিটি জাল। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক রাগীব আলীসহ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলে সিলেট সদরের তৎকালীন ভূমি কমিশনার এসএম আবদুল কাদির কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।

দুটি অভিযোগে তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছে রাগীব আলী ও তার জালিয়াত চক্রের জাল-জালিয়াতির বিস্তারিত তথ্য। অভিযোগপত্রে দেখা যায়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৮নং শাখা থেকে ২০০৫ সালের ১৪ আগস্ট তারাপুর সংক্রান্ত কোনো পত্রই ইস্যু করা হয়নি। অথচ রাগীব আলী ও তার পুত্র আবদুল হাই ওই তারিখের ভূ:ম:/শা-৮/খাজব/৩১৯/৯১/১৭০ স্মারকের চিঠিটি জাল করেছেন। জানা যায়, ওই স্মারকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে র‌্যাব-২-কে ঢাকা জেলায় ৭ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। রাগীব আলী এবং আবদুল হাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হকের স্বাক্ষর এবং ওই চিঠি জাল করেছেন। এর মাধ্যমে তারা তারাপুর চা বাগানের সমুদয় সম্পত্তি নামজারি করে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন। অনুরূপভাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের শাখা-৮ থেকে ১২-১০-১৯৮৯ তারিখের ভু:ম:/শা-৮/খাজব/৫৩/৮৯/৪৪৬নং স্মারকে সহকারী সচিব এমএ মালেকের স্বাক্ষরে পাবনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। এ স্মারক নম্বরটিও জাল করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার ও দেবোত্তর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ভূসম্পদ আত্মসাতের সহায়ক দলিল সৃজন করেন রাগীব আলী ও তার সহাযোগী জালিয়াত চক্র।