ইলিয়াস ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে পারে সিলেট!
নুরুল হক শিপু :: চার বছরেও মিলেনি বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলীর সন্ধান। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এ সংসদ সদস্যকে ফিরে পেতে পুরোনো ইস্যুতে সিলেটের রাজপথ ফের উত্তপ্ত হতে পারে। তাই ইলিয়াস ইস্যুকে আবারও চাঙা করতে নবগঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটির পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। একই সাথে জেলা ও মহানগর বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারাও কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন। আর পুলিশ বলছে, কর্মসূচির নামে কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চাইলে ছাড় দেয়া হবে না।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর সিলেটে ও বিশ^নাথে ব্যাপক আন্দোলন হয়। পরের বছর থেকে কোনো আন্দোলন নয়; বিক্ষোভ মিছিল, মিলাদ আর দোয়া মাহফিলে স্মরণ করা হয় এম ইলিয়াস আলীকে। এবার নতুন কমিটি ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার আন্দোলন কতটা চাঙা করতে পারবে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল পরবর্তী প্রথম সভায় ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবি না করায় ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। এরপরই বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেলা বিএনপির বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবি করে। পরবর্তীকালে গত ৭ মার্চ সিলেট বিএনপিকে কোনো বলয়ের রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না বলে ঘোষণা দেন নবনির্বাচিত সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতারা। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও দলকে ঐক্যবদ্ধ করাই নবগঠিত কমিটির মূল লক্ষ্য বলে অবহিত করা হয় ওই মতবিনিময় সভায়। এ সময় নেতারা প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দলে শৃঙ্খলা ও ঐক্য ফিরিয়ে আনতে চান বলেও ঘোষণা দেন।
এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজের চার বছর পূর্ণ হবে আগামী ১৭ এপ্রিল। ওইদিনকে কেন্দ্র করে তাঁকে ফিরে পেতে জেলা ও মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে ডাক দেয়া হবে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ওই কর্মসূচির কারণে সিলেটে উত্তাপ ছড়ানো হতে পারে। হরতাল-অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ এমনকি অনশনের কর্মসূচিও ঘোষণা করার কথা ভাবা হচ্ছে। আর সেজন্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মিসভা ও মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে কর্মিসভা করে তৃণমূলে দলকে সুসংগঠিত করে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা চলছে।
অবশ্য সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের শামীম বলেছেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৪ বছর হচ্ছে। রহস্যজনক কারণে তাঁকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে না। তাঁকে ফিরে পেতে আমরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করব এবং তা পালনও করব। কর্মসূচিতে হরতাল-অবরোধের ডাক দেয়া হবে এমনটি শোনা যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধই শুধু কঠোর কর্মসূচি নয়; এর চেয়ে বড় কর্মসূচি হলো জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা।’
সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, ‘এখনও আমরা কর্মসূচির বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছাইনি। তবে খুব শীঘ্রই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, ‘বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে এবার তৃণমূল থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য কর্মসূচির বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনও দলের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, কর্মসূচিতে হরতাল-অবরোধ, প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট ও অনশন কর্মসূচি থাকতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে আলী আহমদ বলেন, কর্মসূচি বাস্তবায়নে খুব শীঘ্রই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক কোষাধক্ষ্য ও সেচ্ছাসেবক দলের মহানগরের আহবায়ক কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম বলেন, ‘আমাদের প্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। অতীতে আন্দোলন করতে গিয়ে ইলিয়াস অনুসারী নেতারা হামলা, মামলা ও কারাভোগ করেছেন। এখন যেহেতু জেলা ও মহানগর বিএনপির নতুন নেতৃত্ব এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা গেছে তারা ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে আন্দোলন সংগ্রম করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। তবুও এখন দেখার বিষয় তারা কি আন্দোলন করেন। যদি তারা প্রকৃত পক্ষে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেন, তবে তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীকে একটি বৃত্তের ভেতরে বন্দি না করে বিএনপির আদর্শের সৈনিকদের মধ্যে তাকে বিলিয়ে দিতে চাই।’
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে সিলেট বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা লাগলে করব। কিন্তু কর্মসূচির নামে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটনানোর চেষ্টা করলে জনগণের স্বার্থে যা করার প্রয়োজন আমরা তাই করব। আমরা চাই, সব সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাক।’
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে সন্ধান না পাওয়ায় দলের অনেক নেতাকর্মী ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইলিয়াস আলীর মা, পতœী ও সন্তানেরা আজও তাঁর অপেক্ষায় রয়েছেন। ইলিয়াস অনুসারীরা মনে করছেন, তিনি নিখোঁজের পর থেকেই সিলেট বিএনপি মাঠের একটি আন্দোলনও চাঙা করতে পারেনি। তারা বলছেন, তাঁকে ‘গুম’ না করা হলে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সিলেটের রাজপথে ভিন্ন চিত্র দেখা যেত। ইলিয়াস আলী থাকলে হয়তো সরকার পতনের রোডম্যাপ সিলেট থেকেই রচিত হতো। আন্দোলনে ভিন্ন গতি দেখতেন দেশবাসী।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাক শামীম আহমদ বলেন, ‘প্রিয় নেতার স্বজনেরা আজও তাঁর অপেক্ষায়। তাঁর মা, স্ত্রী, সন্তান পথ চেয়ে রয়েছেন। আমরাও বিশ্বাস করি, একদিন সরকারের ‘গুম’ নামক কারাগার থেকে জীবিত ফিরবেন রাজপথের নেতা এম ইলিয়াস আলী। আর তাঁকে ফিরে পেতে যে-কোনো ধরনের কর্মসূচিতে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকবে।’
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। তারপর তাকে বহনকারী গাড়ির চালক আনসার আলীকেও পাওয়া যায়নি। তবে দুটি মোবাইলফোন-সহ গাড়িটি রাস্তায় পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা তার স্বামীকে খোঁজে বের করে দিতে সরকারের সহযোগিতাও চান। এরআগে একই বছরের ২৩ এপ্রিল ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে হরতাল পালনের সময় বিশ্বনাথ উপজেলায় জনতার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়। এসময় গুলিতে নিহত হন বিএনপির তিন কর্মী। আহত হন শতাধিক। ঘটনার পর উপজেলার অজ্ঞাত পরিচয় আট হাজার জনকে আসামি করে মামলা হয়। কারাবরণ করেন দুই শতাধিক নেতা-কর্মী। ইলিয়াস নিখোঁজের প্রতিবাদে ও তাঁর সন্ধানের দাবিতে সিলেট এ সময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকে সময়ের ব্যবধানে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। সিলেটে বিএনপি নেতারা মিলাদ আর দোয়া মাহফিলে স্মরণ করতে থাকেন ইলিয়াস আলীকে।