সুরমা তীরে ‘নদীর জন্য সংগ্রামের গান’ আজ

05122009_dancing_circle_sylhet_photo1_ranadipam_basuস্টাফ রিপোর্টার :: হন্ডুরাসে নদী সংগ্রামের নেত্রী বেরতা কাসেরেস হত্যার প্রতিবাদে ও নদীরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথে আজ শনিবার অনুষ্ঠিত হবে ‘নদীর জন্য সংগ্রামের গান’। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস ২০১৬ সামনে রেখে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখা ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার যৌথভাবে সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাটের সিঁড়িতে বিকেল ৪টায় এ অনুষ্ঠান শুরু করবে। ‘নদীর জন্য সংগ্রামের গান’ পরিবেশন করবে নগরনাট সিলেট ।
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কীম জানান, গত ৩ মার্চ হন্ডুরাসে নদী সংগ্রামের নেত্রী বেরতা কাসেরেস নিহত হয়েছেন। নিজ বাসভবনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি পরিবেশ আন্দোলনে অবদানের জন্য গত বছর গোল্ডম্যান পরিবেশ পুরস্কার পেয়েছিলেন। চার সন্তানের মা বেরতা কাসেরেস (৪৫)-এর অপরাধ গুয়েলকারকুয়ে নদীর উজানে আগুয়া যারকা ড্যাম নির্মাণের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কারণে প্রকল্পটি বাতিল হয়।
কাসেরেসের পরিবার দাবি করেছে, ওই বাঁধের বিরোধিতা করার কারণে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অব্যাহত হুমকির মুখে ছিলেন তিনি। বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে লিনকা আদিবাসীদের আন্দোলন শুরুর মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন বেরতা কাসেরেস। এ ছাড়া কয়েকটি বহুজাতিক খনি কোম্পানির পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, এ হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ একটি খুন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে সরকার।
নিহতের মেয়ে অলিভিয়া জুনিগা ক্যাসেরেস বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এর আন্তর্জাতিক তদন্ত হওয়া দরকার।’ গত ৬ মার্চ কাসেরেসের নিজ শহর লা এসপারেনসাতে হাজার হাজার মানুষ তাঁর লাশবাহী কফিন নিয়ে মিছিল করেছে। বিশ্বব্যাপী নদী আন্দোলনের কর্মীরা বেরতা কাসেরেস হত্যার প্রতিবাদ করছে। নদীর জন্য তাঁর এই মহান মৃত্যু দেশে দেশে নদী সংগ্রামের অনুপ্রেরনা হয়ে থাকবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশেও নদীরক্ষায় সংগ্রাম করতে হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নদীশত্রুদের বিরুদ্ধ্যে ।
বাপা সিলেটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নিকট অতীতে শত নদীর প্রবাহ ছিল বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল সিলেট বিভাগে। অধিকাংশ নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকিতে। সিলেট বিভাগের প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারার উজানে বরাক নদীতে ভারত সরকারের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘টিমাইমুখ ড্যাম’ এখনো বাতিল ঘোষিত হয় নি। এ অঞ্চলের ছোট ছোট কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদী ধলা, পিয়াইন, সারী গোয়াইন, সোনাইবরদল, মনু, ধলাই, জুরি, লংলা, লোভা, যাদুকাঁটা, খোয়াই, সুতাং ও সোনাই। এরই মধ্যে ধনু, মনু, ধলা, পিয়াইন, খোয়াই ও ধলাই নদীতে বাঁধ ও স্লুইসগেট করে শুকনো মৌসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। বহু আগেই মনু নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যের কেলা শহরের কাছে কাঞ্চনবাড়িতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ওই বাঁধ থেকে তারা মনু নদীর পানি একতরফা নিয়ন্ত্রণ করছে। ধলা উজানে ত্রিপুরার কুলাইয়ে একটি বাঁধ নির্মাণের ফলে মনু ও ধলা শুকনো মৌসুমে থাকে পানিশূন্য। পিয়াইন নদীর মাতৃনদী ডাউকি নদীর পশ্চিম তীরে ভারত ৪৩ মিটার লম্বা, ৯ মিটার চওড়া ও ৯ মিটার উঁচু গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে। এ গ্রোয়েনের কারণে জাফলং কোয়ারিতে পাথর আসার পরিমাণ কমে গেছে। খোয়াই নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যের চাকমাঘাটে ও কল্যাণপুরে দুটি বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। খোয়াইর ভারতীয় অংশে শহর প্রতিরক্ষার নামে স্পার নির্মাণ করে নদীকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কুশিয়ারায় গ্রোয়েন নির্মাণ করে এর স্রোত ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে।
সীমান্ত নদী সারি বা সারিগোয়াইনের মাইনটডু ও লিমরিয়াং। মাইনটডু এবং লিমরিয়াং নদীর মিলিত গ্রোত সারি গোয়াইন নদীর নাম নিয়ে সিলেটের জৈন্তাপুরের লালাখাল নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মাইনটডু-লেসকা ড্যামটি ওমশাকিন, মাইনটডু এবং লামু নদীর সংযোগস্থল লেসকার ১শ’ মিটার উজানে অবস্থিত। এটি জৈন্তিয়া হিলস জেলার আমলারেম ব্লকের দেংশাকাপ গ্রামের কাছে তৈরি হয়েছে। মেঘালয় রাজ্য বিদ্যুত্ বোর্ড এ প্রকল্পের ৩টি ইউনিট থেকে ৪২ মেগাওয়াট করে মোট ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ করার জন্য বাঁধ দিচ্ছে। ড্যামটির উচ্চতা ৫৯ মিটার। ড্যামের স্থাপনার মধ্যে রয়েছে লেসকা পয়েন্টে জলাধার এবং এর সঙ্গে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কন্ডাক্টর সিস্টেম। যাতে আছে প্রেসার টানেল এবং পেনস্টেক পাইপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাঁধের জলাধারে তারা ইচ্ছামত পানি ধরে রাখতে পারবে এবং প্রয়োজনে ছেড়ে দিতেও পারবে।
ফলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সারি নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব দেখা দেবে এবং বর্ষাকালে ভাটির দেশ বাংলাদেশ অতিপ্লাবনের মুখে পড়বে। এ বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। চলতি বর্ষা মৌসুমে সারি নদীতে উজানের ঢল নামেনি। ফলে সীমান্তবর্তী হরিপুর হাওরসহ জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল ও খালে পর্যাপ্ত পানি হয়নি। সিলেট বিভাগে প্রবেশকারী প্রায় প্রতিটি আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে বাঁধ নির্মান করছে ভারত। যা আন্তর্জাতিক নদী আইনের চরম লঙ্ঘন।
এদিকে সিলেটের প্রধান নদী সুরমা’র উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সুরমা বরাক নদী থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরছে। যা সুরমার জন্ম পরিচয় বদলে দেবে। সিলেটের অধিকাংশ নদীই বিপন্ন। সিলেটের অভ্যন্তরেও নদীসমুহের সাথে বৈরি আচরণ চলছে। পিয়াইন, সারি, ধলাই, লোভা, যাদুকাটা, চলতি নদী, রাংপানি ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্থ করে পাথর উত্তোলন চলছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অপরিকল্পিত এই পাথর উত্তোলনে ডাউকি নদী আজ হারিয়ে গেছে। সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই ও মনূ নদী নানাভাবে বর্জ্য দূষণের স্বীকার। সোনাই নদীর অভ্যন্তরে নির্মিত সায়হাম ফিউচার পার্ক নদীরক্ষায় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতার নির্মম সাক্ষী। মাধবপুর-চুনারুঘাটে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল সুতাং, সুনাই, বলভদ্র নদীর পানি বিষাক্ত করছে। এখানকার অধিকাংশ নদী বালু ব্যাবসায়ীদের মুনাফার আঁধার । ইচ্ছেখুশি বালু উত্তোলন এখানে স্বাভাবিক বিষয়। চলমান এই পরিস্থিতি সিলেট তথা দেশের জন্য ভয়াবহ দুস্কাল নিয়ে আসবে । সিলেটের পরিবেশ প্রতিবেশ সুরক্ষায় প্রতিটি নদীকে বাঁচাতে হবে। নদীর পাশে দাঁড়াতে হবে । নদীর সাথে হওয়া অন্যায় চিহ্নিত করে প্রতিরোধে নামতে হবে । আন্তঃসীমান্ত নদীর সমস্যা সমাধানে ভারতকে চাপে রাখতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে । মৃত ও ভরাট নদী ড্রেজিং করে তার প্রবাহ ও নাব্যতা পূনরোদ্ধার এবং নদীর মাটি/পাড় ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। ভুমি মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসমূহ, নগর উন্নয়ন সংস্থাসমূহ, বিআইডব্লিটিএ, নদী কমিশন, নদী টাস্কফোর্সকে দৃঢ়ভাবে নদী-বান্ধব নীতি অনুসরণ করতে হবে। নদীতে বাঁধ-ব্যারেজ-রেগুলেটর বসানোর ‘বেষ্টনী নীতি’ ভিত্তিক  ভুল নদী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বন্ধ এবং ‘বাংলাদেশ ডেল্টা পরিকল্পনার ২১০০’ নামে সেই একই ভুল ব্যবস্থাপনা চালুর সাম্প্রতিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশকে জাতিসংঘ প্রণীত পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭ অবিলম্বে স্বাক্ষর ও সে অনুয়ায়ী নদীরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতকে উক্ত আইন অনুস্বাক্ষরে রাজী করাতে হবে ও তার ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে সকল আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট শাখা ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার নদীরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথে ও নদী সংগ্রামী বেরতা কাসেরেস হত্যার প্রতিবাদে ‘নদীর জন্য সংগ্রামের গান’ আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই আয়োজনে যুক্ত হয়ে নদীর জন্য সংগ্রামের শপথ নেয়ার আহবান জানানো হয়।