শায়খ আবদুল হাই চলে যাওয়ার ৬ বছর

Abdul Haiসিলেটের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর জামে মসজিদের দীর্ঘ ৫৬ বৎসরের ইমাম ও খতিব, শায়খ আবদুল হাই। ২০১০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন আপন মাওলার সান্নিধ্যে। ৭৮ বৎসরের দীর্ঘ জীবনটি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেশ, মাটি ও মানবতার কল্যাণে। হেদায়াতের আলোকবর্তিকা বিচ্ছুরিত করেছিলেন দশ-দিগন্তে। স্থানে স্থানে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মানুষ গড়ার বহু কারখানা। আল্লাহর খাটি বান্দা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে লুকিয়ে রাখার নজির স্থাপন করে গেছেন পৃথিবীবাসীর জন্যে। তার সারাটি জীবন ছিল মানুষের কাছে অজানা।
১৯৩২ সালের ১১ই মার্চ বিয়ানীবাজারের মাথিউরা গ্রামে বাহাদুরি বাড়িতে তার জন্ম। পিতার নাম মুনশি আবদুল হাসিব। মাতার নাম খুরশিদা খানম। মাত্র ছয় বছর বয়সে কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। গ্রামের পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়ার পর চলে যান দারুল উলুম দেউলগ্রমে। কিছুদিন পর ভর্তি হন গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদরাসায়। সেখানে ফাজিল কাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে ছুটে যান বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি ইউনিভার্সিটি দারুল উলুম দেওবন্দে। সেখানে লেখাপড়া করেন কৃতিত্বের সাথে। ধন্য হতে থাকেন শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদের সুহবাতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আইনের জটিলতা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর নির্দেশ “দেওবন্দের সকল বহিরাগতদের ভিসা বাতিল! পড়তে হলে নতুন ভিসা ইস্যু করতে হবে।” সরকারি নির্দেশে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরতে হল। কিন্তু দুর্ভাগ্য! পরে আর ভিসা মেলেনি। প্রাণের দেওবন্দে আর দ্বিতীয়বার যাওয়া হয়নি। ভর্তি হলেন ঢাকা লালবাগে। শামসুল হক ফরিদপুরি, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মাওলানা কেফায়াত উল্লাহ, মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর প্রমুখ হাদিস বিশারদগণের নিকট থেকে হাদিস শাত্রের ডিগ্রি লাভ করেন। দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ হন কৃতিত্বের সাথে। লেখাপড়ার পিপাসা এখনো মিটেনি। ডাক পড়ে যায় কর্মজীবনের। তরুণ আলেম। বিরল আমল আখলাক। দেখতে সুদর্শন। সুললিত কণ্ঠস্বর। মার্জিত স্বভাব। নেতৃত্ব দানের উপযোগী এরকম একজন মানুষ খুঁজছিলেন আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর এলাকাবাসী। সকলের চোখ পড়ল তার দিকে। গ্রামের মুরব্বিরা তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি অসম্মতি জানালেও বাধ্য। নাছুড় বান্দা তারা। অবশেষে ১৯৫৬ সাল থেকে ইমামতির গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সেই সাথে দারুল উলুম দেউলগ্রাম মাদরাসা থেকে শিক্ষকতার প্রস্তাব এল। সেটিও গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। ইমাম ছিলেন দীর্ঘ ৫৬ বছর। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কেউ তার ইমামতিতে কোনো দিন অভিযোগ তোলে নি। গ্রামের সকলেই তাকে সমীহ করত। শ্রদ্ধা জানাত। অন্তর থেকে ভালবাসত। এমনকি জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও তার পেছনে নামায পড়তে সবাই আগ্রহী ছিল।
শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি জামেয়া। নাম তার জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর। তিলে তিলে সেই জামেয়া আজ তার ঐতিহ্যের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের আনাচে কানাচে। হাজারো আলেম-হাফিয জন্ম দিয়েছে সে। তৈরি করে যাচ্ছে অসংখ্য লেখক; সাংবাদিক; সাহিত্যিক; রাজনীতিবিদ। এককথায় সমাজের সর্বস্তরে কা-ারির ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এরা।
শায়খ আবদুল হাই শুধু জামেয়া আঙ্গুরাই নয়; প্রতিষ্ঠা করেছেন এ রকম আনেক প্রতিষ্ঠান। সিলেটের অন্যতম ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুস সুন্নাহ মুরাদগঞ্জ টাইটেল মাদরাসা, মাথিউরা দারুল কুরআন মাদরাসা, জামিয়া মাদানিয়া তাহফিজুল কুরআন ফেঞ্চুগঞ্জ, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মহিলা মাদরাসা, আকাখাজনা মহিলা মাদরাসা, জামিয়া তায়্যিবা গোবিন্দশ্রীসহ আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তারই হাতের লাগানো বাগান। এ ছাড়া তানযীমুল মাদারিস সিলেট বিভাগ, মহিলা দ্বীনী শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে ইজহারে হক ইত্যাদি বোর্ড তারই হাতের সুবিমল স্থাপনা।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন আকাবির আসলাফের রেখে যাওয়া আমানত জমিয়তের অন্যতম দিঙ্নির্দেশক, তার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আঙ্গুরা জমিয়তের একটি দূর্গ বললেই চলে। এখান থেকেই অসংখ্য কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় জমিয়তের। বাতিলের বিরোদ্ধে উচ্চারিত হয় সাহসী কণ্ঠ। তারই হাতেগড়া ব্যক্তিত্ব আল্লামা শায়খ জিয়া উদ্দিন এখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।
সাদা দাড়ি-টুপি আর লম্বা জুব্বাধারী সেই মহাপুরুষ নিজে এত বড় বুযুর্গ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে সর্বদা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা প্রকাশ পেয়ে যায় ইন্তেকালের পর। সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে তার জানাযায়। বিয়ানীবাজার পি.এইচ.জি মাঠে ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হয় তার জানাযা। কানায় কানায় ভরে যায় সারা মাঠ। প্রিয় মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে মানুষ ছুটে আসে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ দলমত নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অবশেষে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জামেয়া আঙ্গরার আঙিনায়।
Abdul Kadirলেখক: স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট মিডিয়া
[email protected]
০১৭২৩-৬২৪২৪২