ভাষার প্রতি ভালোবাসা
বাংলা ভাষার বিশেষত্ব কি ? আমাদের মাতৃভাষা বলেই কি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি আমরা করি ? গোটা বিশ্বের ৭০০ কোটির অধিক মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ হলে ৩০-৩২ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা । কাজেই সংখ্যার হিসেবে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের কোন সম্ভাবনা নাই । বিশ্বের সর্ববৃহত্তর জনবহুল দেশ চিন তাদের মাতৃভাষা মান্দারিন । আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজী এবং বিশ্বের চার’শ কোটি মানুষের বেশি এ ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে । মুসলিমদের প্রিয় ভাষা আরবী । ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর ভাষা ফার্সি ও উর্দু । আমাদের পাশবর্তী দেশ ভারতে কম করে হলেও ১৮টি ভাষার প্রচলন রয়েছে । এর বেশিরভাগ ভাষা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বাংলাদেশের বাংলা ভাষীর চেয়ে বেশি । তবে আমার মায়ের ভাষা বিশ্বের বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেল কেন ? হ্যা পাঠক ! যৌক্তিক কারণ তো অবশ্যই রয়েছে । সালাম, জব্বার, রফিক, শফিক কিংবা বরকতদের আত্মত্যাগ তথা আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসার বদৌলতে আজ বাংলা ভাষা বিশ্বের মানুষের কাছে স্বতন্ত্র গৌরবের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে । আগামীকাল গোটা বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের উদ্যোগে পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । একজন বাংলাভাষী হিসেবে এর চেয়ে গর্বের আর কি থাকতে পারে ? আমার ভাষাকে, ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বিশ্বের শত কোটি মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে । বিশ্বের অনেক জাতির গর্ব করার মত অনেক বিষয় রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশী ছাড়া এমন কোন দ্বিতীয় জাতিকে পাওয়া যাবে না যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে । আজ আমাদের সীমান্তবর্তী পশ্চিম বঙ্গের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে গর্ব অনুভব করে সেটা আমাদের পূর্বপুরুষদের দান ।
….
বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী বাংলা ১৩৫৯ বাঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন ছিল-এটা জানা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় । আবার এটাও লজ্জার, যে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষেরা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলেছে, প্রাণ উৎসর্গ করেছে, জেল-যন্ত্রনাময় শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে সেই ভাষা আজ আমাদের দ্বারাই বারবার মানহানীতে পড়ছে । যে জাতির ইতিহাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্ম হয়েছে সে জাতির অভ্যন্তরে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত না হওয়াটাও সৌভাগ্যের লক্ষণ নয় । একজন বাংলাদেশের বাংলাভাষী হিসেবে পৃথিবীর সকল ভাষা শিক্ষা করার মধ্যে কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই যদি-না শুদ্ধ বাংলা চয়ন ও লিখনে পারদর্শী না হই । এদেশের এমন শিশু-তরুণের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় যারা বাংলা ঋতুর নাম, মাসের নামগুলো ধারাবাহিকভাবে বলতে পারে না ।
….
আমাদের ভাষা প্রেম যদি শুধু ২১ ফেব্রুয়ারী উথলে ওঠে এবং ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হলেই সে প্রেমে মরুভূমির পরিণতিতে পরিবর্তিত হয় তবে সালাম, বরকতের ত্যাগের কোন মান আমাদের থেকে প্রতিষ্ঠা পায় না । সর্বত্রই রাস্তায় রাস্তায় কিছু ব্যানার, পোষ্টারে বাংলা ভাষার বিকৃতি এবং কিছু অনলাইন পোর্ট্রালে বাংলা ভাষারীতির অবমামনা দেখা সাক্ষাৎ মেলে । এসবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা থাকলেও এগুলো বন্ধ করণে কোন ধরণের পরিকল্পিত পদেক্ষপ চোখে পড়ে না । ফেব্রুয়ারী এলেই আমাদের মাতৃভাষার চেতনা জাগরুক হয় অথচ অন্য মাসগুলোতে হিন্দি কিংবা ভিন্ন ভাষার প্রতি পরকীয়ার হুল্লোরময় উৎসব চলে !
….
রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে অর্জনের ৬০তম বর্ষে দাঁড়িয়েছি অথচ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলাকে ব্যবহারের জন্য যতটুকু ভালোবাসা থাকা উচিত ছিল তার কতটুকু রয়েছে তা স্ব স্ব ব্যক্তিসত্ত্বার কাছে প্রশ্ন রাখলেই বোধহয় উত্তমরূপে জ্ঞাত হওয়া যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যক্তির অলসতার চেয়ে রাষ্ট্রীয় অবহেলাকেই বেশি দায় করা চলে । কেননা রাষ্ট্র যদি সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহারের প্রতি বাধ্যবধকতা আরোপ করে এবং তা বাস্তবায়নে যথার্থ উদ্যোগ নিত তবে শহরের অধিকাংশ জায়গায় ইংরেজীতে লেখা পোষ্টার কিংবা প্রথমে ইংরেজীতে লিখে তারপর বাংলা লেখা পোষ্টার, ব্যানার দেখতে হতো না বরং আগে বাংলাকে নিশ্চিত করে তারপর ইংরেজী কিংবা প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করতাম ।
…..
এবার এসেছে শপথের পালা, আসুন ! বাংলাকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসতে শিখি । যে ভাষার দাবীতে শাসকের ছদ্মবেশি শোষকের বুলেটে আমাদের ভাইদের প্রাণ কেড়েছে সে ভাষার অমর্যাদা কোনভাবেই বরদাশত যেন না করি । আমাদের আত্মার মত করে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমেই ভাষা শহীদের আত্মায় শান্তির বার্তা পাঠাতে সচেষ্ট হই । প্রাণের ভাষা তথা আমাদের গর্বের ভাষা বেঁচে থাকুক আরও অযুত সহস্র শতাব্দী । আপন আঙ্গিকে, চির গৌরবে ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
facebook/rajucolumnist/