সিলেট মহানগরীতে চুরি-ডাকাতি : পুলিশের হিসেব আর বাস্তবে অনেক ফারাক

smp Policeস্টাফ রিপোর্টার: সিলেট মহানগরী ও আশপাশের এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এর হার অনেক বেশি। চুরি-ডাকাতি বাড়লেও পুলিশের হিসেবে দেখানো হচ্ছে কম। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ-এসএমপির অপরাধ পরিসংখ্যানে গত বছর তাদের ছয় থানায় মাত্র ১৯ ডাকাতির ঘটনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই হার অনেক বেশি। কোন কোন মাসে ৮ থেকে ১০টি ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে। এক রাতেই নগরীর রায়নগরে পুলিশের বাসা ও বিয়ে বাড়িসহ ৩টি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনাও ঘটে। ২৭ জুন আখালিয়ায় প্রবাসী ও অপর এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি হয়। চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারিতেই শিবের বাজারে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। পরে টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও সংঘর্ষ হয় ডাকাতদের মাঝে।
তবে পুলিশের তালিকায় এসবের অনেকটাই নেই। অভিযোগ রয়েছে, সংখ্যা কম দেখানোর জন্য বেশিরভাগ ডাকাতিকে চুরি বলে চালিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। এমনকি অনেক ঘটনার পর থানায় মামলা করতে গেলে তা না নেয়ারও অভিযোগ ওঠেছে। ফলে এসব ঘটনার পুরোটাই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। ডাকাতির পর মালামাল উদ্ধার করতে পারছে না পুলিশ। সাময়িক তোড়জোড় দেখালেও অভিযুক্তরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ কারণে সিলেট মহানগরীতে ডাকাতি না কমে বরং দিনদিন বেড়েই চলছে। শুধু ডাকাতিও নয়। গেল বছর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এসএমপি এলাকায় শিশু খুন, ধর্ষণ-গণধর্ষণ, দস্যূতা, ছিনতাই, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশ সদস্যের অপরাধ, অস্ত্রবাজি, চোরাচালন ও মাদক ব্যবসা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এতে সিলেটের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল।
সূত্র জানায়, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতে চুরি-ডাকাতির হার বেড়ে যায়। একই চিত্র চলতি বছরেও দেখা যাচ্ছে। গেল বছরের শীতের সিরিয়াল ডাকাতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পুলিশ কোনো প্রকৃত ডাকাত সনাক্ত করতে পারেনি। বেশিরভাগই সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছে পুরনো মামলার কিছু আসামিদের। শুধু শাহপরাণ থানা এলাকায় ডাকাতিকালে গণপিটুনিতে নিহত চার ডাকাতের মামলাটি তদন্ত করা হয়েছে। বাকি সব ডাকাতি মামলাই আছে তদন্তাধিন। এসব মামলায়, ভিন্ন শ্রেণীর অপরাধীদের ডাকাত বানিয়ে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হচ্ছে। যে কারণে, প্রকৃত সিরিয়াল ডাকাতরা ধরা পড়ছে না। এসএমপি পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসান এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
উপ-পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ চলতি সময়ে ডাকাতি বাড়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি এর জন্য শীত ও কোয়াশাকে দায়ি করেন। বলেন, পুলিশি টহল থাকলেও ঘনকোয়াশাকে কাজে লাগিয়ে ডাকাতরা অপরাধ সংগটিত করতে পারছে। তাদের আটকের বিষয়ে পুলিশ চেষ্টা করছে বলে জানান।
সূত্র মতে, গত বছরের ২ ডিসেম্বর নগরীর আখালিয়া হালদারপাড়ার উপজেলা প্রকৌশলীর বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১১ ডিসেম্বর জালালাবাদ থানাধীন বলাউরা গ্রামের সৌদি প্রবাসী নূর মিয়ার বাড়িতে ডাকাতি হয়। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি নগরীতে এক আইনজীবীর বাসায় ডাকাতি হয়। ২৬ জানুয়ারি ডাকাতি হয় নগরীর বনকলাপাড়ায়।
এসএমপি এলাকায় গত বছর শিশু সামিউল আলম রাজন ও স্কুলছাত্র সাঈদ থেকে শুরু করে শিশুসহ ৩৭ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মাত্র ৭ টি মামলার অভিযোগপত্র দিতে পেরেছে পুলিশ। এখান থেকে বিচারাধীন রয়েছে ৫ টি মামলা। শিশু সাঈদ ও শিশু রাজনের খুনের বিচার হয়ে খুনিদের সাজা হয়েছে। বাকি ২৪ টি খুনেরই আসামি সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তে গাফিলতি, তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নিয়ে মামলায় জটিলতা তৈরির অভিযোগও আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ দুটি আলোচিত হত্যা বনফুলের দুই কর্মী খুন ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগকর্মী হাবিব হত্যার ১১ খুনিকে ধরতে পারেনি পুলিশ। একইভাবে শাবিতে গাড়ি চাপায় শিক্ষকসহ দুজনকে হত্যাকারী অধ্যাপক আরিফুলকেও খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
এসএমপি এলাকায় ধর্ষণও বেড়েছে। গত বছর ১৬ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৩ টি ধর্ষণ মামলার চার্জশিট দিতে পেরেছে পুলিশ। চলতি বছরের শুরুতেই এয়ারপোর্ট থানা এলাকার পিঠাখাওরা এলাকায় তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়। কিন্তু ধর্ষককে এখনো আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত বছর সিলেট শহরে ৮টি মাদক চোরাচালানের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে র‌্যাবের হাতে করিম উল্লাহ মার্কেটের সামনে এক ট্রাক পলিথিন আটক করা হয়। তবে ২০১৪ সালে সিলেট নগরে সবচেয়ে বেশি চোরাচালান হয়েছে। ওই সময়ে এসএমপিতে ১৮ টি চোরাচালান মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, পুরনো মাদক পাচারকারীরা আবারও সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ও আশপাশ এলাকায় মাদক ব্যবসা শুরু করেছে। নগরীর লালদিঘীরপাড় , কালিঘাট ও বারুতখানায় ফের ফেনসিডিল ব্যবসা হচ্ছে। দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডের বৈদেশিক ডাকঘরের রাস্তায় গিয়ে খারের পাড়ের রঙকরা ঘরে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেছে একটি চক্র। এই চক্রের অনেক সদস্যকে র‌্যাব ধরেছে। তবে, এরা জামিনে বেরিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করে। গত বছর এসএমপি এলাকায় ১৮৩ টি মাদক পাচারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। চলতি বছর মাদকের বিরুদ্ধে এখনো জোরালো কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। নগরীতে অস্ত্রবাজিও বেড়েছে। সন্ত্রাসীরা জমি দখল থেকে শুরু করে গ্রুপিং মারামারিতে ব্যবহার করছে অস্ত্র। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরাও অস্ত্র মজুদ করছে। গত বছর নগরীতে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে ১১ টি। পুলিশ ৬ টি ঘটনায় চার্জশিট দাখিল করেছে।
সিলেটে বর্তমানে আলোচিত বিষয় হচ্ছে খুন, ছিনতাই, অপহরণের সাথে পুলিশ সদস্য জড়িয়ে পড়া। শিশু সাঈদ হত্যাসহ নগরীতে একাধিক ছিনতাইর ঘটনায় পুলিশ সদস্য আটক করা হয়। অপহরণেও জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ সদস্যরা। অপহরককারীদের চক্রে যোগ দিয়েছে ডিবি পুলিশও। সিলেট নগরীতে আদালত থেকে প্রকাশ্যে কোর্ট সার্ভার লিটনকে ডিবি পুলিশের এক সদস্যের নেতৃত্বে অপহরণ করা হয়েছিল। গত বছর এসএসমপিতে অপহরণ হয়েছে ১০ টি। তদন্তে চার্জশিট হয়েছে ৫ টি ঘটনার। গত বছর এসএমপির ছয় থানা এলাকায় মোট ৫৪ টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬ টি।
সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু খুনসহ সকল খুনের ক্ষেত্রেই তদন্তে ব্যর্থতা কাম্য নয়। এসব বিষয়ে পুলিশই পারে দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে। এমনকি, পুলিশ চাইলে দ্রুত সাক্ষের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তিও সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় আমরা হতাশ হচ্ছি।
র‌্যাব-৯ উপ-পরিচালক (মিডিয়া) মেজর এসএএম ফখরুল ইসলাম খান, বীর বলেন, ‘মাদকের ব্যাপারে র‌্যাব আপোষহীন। আমাদের নিয়মিত অভিযান হচ্ছে। পুরনো ব্যবসায়ীরা যারা জামিনে বের হয়ে আবার সক্রিয় তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’