পাসপোর্ট ফি’র ৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও আইরিশ

bangladesh-passportsডেস্ক রিপোর্টঃ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)-এর জমাকৃত ফি’র মোটা অঙ্কের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়নি আউটসোর্সিং কোম্পানি আইরিশ করপোরেশন বারহাড। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত মালয়েশীয় এ আউটসোর্সিং কোম্পানিটি পাসপোর্ট
ফি’র জমাদানের ক্ষেত্রে এমন কাজটি করেছে। এনিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চলছে তোলপাড়। পাঁচ কোটি টাকা জমা না দেয়ার বিষয়টি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (কনস্যুলার) মো. জসীম উদ্দীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানিয়েছেন। এরপর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইরিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাতে ওই কোম্পানিটি সাড়া দিচ্ছে না। এখন বাধ্য হয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি ভাবছে সরকার। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি মানবজমিনকে জানান, এ বিষয়ে সহসাই আইরিশকে চিঠি দেয়া হবে। তাদের জবাব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইরিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৪শে নভেম্বর পর্যন্ত তারা ৩৭ হাজার ৩৫৩টি পাসপোর্টের আবেদনপত্র নিবন্ধন (এনরোলমেন্ট) করেছে। এর মধ্যে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে ৩৫ হাজার ৬৭১টি পাসপোর্ট বুঝে পেয়ে আবুধাবি ও দুবাইস্থ বাংলাদেশ মিশন আউটসোর্সিং কোম্পানির কাছে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু এসব পাসপোর্টের বিপরীতে জমাকৃত ফি ও সার্ভিস চার্জ জমা দেয়া নিয়ে অসাধুতার আশ্রয় নিয়েছে আউটসোর্সিং কোম্পানি। পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ ও পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়ার জন্য আইরিশের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী আবেদনকারীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ফি (সাধারণের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ১২৫ দিরহাম বা দুই হাজার ছয় শ’ ৪৮ টাকা ও পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে ৪০৫ দিরহাম বা আট হাজার ৫৭৮ টাকা) এবং সার্ভিস চার্জ (জনপ্রতি ৫০ দিরহাম বা এক হাজার ৬০ টাকা) আদায় করে আউটসোর্সিং কোম্পানি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ অর্থ জমা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস, আবুধাবি এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, দুবাইয়ের অধীনে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে জনতা ব্যাংকে আলাদা আলাদা হিসাব খোলা হয়। প্রথম সচিব তার চিঠিতে জানান, চুক্তি অনুযায়ী আউটসোর্সিং কোম্পানি ৩৭ হাজার ৩৫০টি পাসপোর্টের নিবন্ধন করেছে। এর বিপরীতে পাসপোর্ট ফি বাবদ ৪৬ লাখ ৬৯ হাজার ১২৫ দিরহাম বা নয় কোটি ৮৮ লাখ ৯২ হাজার ৬৮ টাকা (জনপ্রতি ১২৫ দিরহাম হারে) ও সার্ভিস চার্জ বাবদ ১৮ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫০ দিরহাম বা তিন কোটি ৯৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮২৭ টাকা আদায় করে তারা। এসব অর্থ সরকারি খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কারণ পাসপোর্ট জমা দেয়ার সময় ওই অর্থ আউটসোর্সিং কোম্পানির অফিসে আবেদনকারীরা পরিশোধ করেন। চিঠিতে জানানো হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের (আবুধাবি ও দুবাই জনতা ব্যাংক) হিসাবগুলো থেকে গত ৩রা জানুয়ারি একটি হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করা হয়। ওই হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, পাসপোর্ট ফি খাতে ২৮ লাখ ৬২ হাজার ছয় শ’ ৩৫ দিরহাম ও সার্ভিস চার্জ খাতে ১২ লাখ ৭১ হাজার ৭৫০ দিরহাম জমা হয়েছে। এ হিসাবে ফি ও সার্ভিস চার্জ বাবদ আদায়কৃত অর্থ ও জমাকৃত অর্থের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এ হিসাবে পাসপোর্ট ফি বাবদ ১৮ লাখ ছয় হাজার ৪৯০ দিরহাম অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং সার্ভিস চার্জ ফি বাবদ পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার নয় শ’ দিরহাম অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় এক কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ১৬২ টাকা বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ কোটি আট লাখ ৮৮ হাজার ৬২০ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়নি আউটসোর্সিং কোম্পানিটি। এদিকে গত ১লা জানুয়ারি থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাসপোর্ট দেয়ার জন্য সব সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে আউটসোর্সিং কোম্পানি আইরিশ। তাদের সেন্টারে নোটিশ দিয়ে তারা বলেছে, বাংলাদেশি নাগরিকদের দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য। সরকারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রাখছেন না তারা। এ কারণে সরকারি অর্থ আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলছে হ-য-ব-র-ল কারবার। এ তিন দেশে পাসপোর্টের আবেদন জমা গ্রহণ ও বিতরণ কাজে নিয়োজিত মালয়েশীয় কোম্পানি আইরিশ করপোরেশন বারহাডের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। বিষয়টি সম্পর্কে এরই মধ্যে মালয়েশীয় কোম্পানিকে কয়েক দফা সতর্ক বার্তা দিয়েছে প্রবাসে এমআরপি বিতরণ সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গত সোমবার সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আইরিশের এমআরপি সংক্রান্ত অর্থ জমাদান নিয়ে নয়-ছয়ের চিত্র তুলে ধরে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে আইরিশের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। গত ১২ই এপ্রিল রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আইরিশ বর্তমানে রিয়াদ, দাম্মাম ও বুরাইদাহ এলাকায় এমআরপি প্রসেসিংয়ের কাজ করছে। এসব এলাকায় তারা প্রতিদিন ১৭০০ এমআরপি প্রসেসিং করছে। গত ৭ই এপ্রিল দূতাবাসে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৭ হাজার ৬২৭টি পাসপোর্টের প্রসেস করেছে। এর বিপরীতে নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সাত কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬২ টাকা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু তারা মাত্র দুই কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ২৬৫ টাকা জমা করেছে। জন্ম নিবন্ধন ফি’র নির্ধারিত টাকাও তারা জমা করেনি। এ কারণে অতি দ্রুত আইরিশকে অর্থ জমা দেয়ার নির্দেশনা দিতে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার এমআরপি বিতরণ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) বিতরণে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এমআরপি বিতরণে আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এর ব্যতিক্রম হলে আগামী এক মাস পর চুক্তি বাতিল করা হবে। বৈঠকে পাসপোর্টের ডিজি এনএম জিয়াউল আলম সভাকে জানান, সৌদিতে বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যে আইরিশ প্রতিদিন এক হাজার দুই শ’ ৫৮টি এমআরপি প্রসেস করছে। যদিও গত ১৯শে মার্চ তারা অঙ্গীকার করেছিল প্রতিদিন নয় হাজার পাসপোর্ট প্রসেস করবেন। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে তারা প্রতিদিন ১২৫ থেকে ১৫০টি এবং মালয়েশিয়াতে ৮৯টি পাসপোর্ট প্রসেস করছেন। যদিও তারা এ দুই দেশে পাঁচ হাজার করে পাসপোর্ট প্রসেসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পাসপোর্টের ডিজির কথা শোনার পর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রবাসীদের একটি বড় কর্মযজ্ঞে ভুয়া কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ সময় প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি গভীরভাবে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইরিশের সিনিয়র অফিসিয়ালদের মধ্যে কেউ ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। শুধুমাত্র দুই জন প্রতিনিধি তাদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে তারা বলেন, আমরা আগামীতে আরও প্রস্তুতি নিয়ে এ সভায় আসবো। তবে আইরিশের সেলস ম্যানেজার পাসপোর্ট প্রসেসে দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ইনশাআল্লাহ এ অবস্থা শিগগিরই কেটে যাবে। তার কথা কেড়ে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী তাদেরকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এমআরপি পাসপোর্টের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে আইরিশ কোনো মতেই উপযুক্ত কোম্পানি নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশি হাই কমিশনার শহিদুল ইসলাম এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে উচ্চপর্যায়ের কমিটির সদস্যদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তারা বলেন, গত এক বছর ধরে আইরিশ সরকারকে নানাভাবে ঘুরাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর ঠিকভাবে এমআরপি না দিতে পারার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইরিশকে কাজ দেয়ার মূল কলকাঠি নাড়েন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আবদুল মাবুদ, প্রকল্প পরিচালক মাসুদ রেজওয়ান ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব সফিকুল ইসলাম। পাশাপাশি তারা আইরিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব সময় অনীহা প্রকাশ করেছেন। এ কারণে প্রায় দেড় বছর সময় নষ্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসীদের এমআরপি’র বিষয়টি দেখভালের জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পাসপোর্টের ডিজিকে আইরিশের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে আইরিশ তাদের প্রতিদিনের প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে জানাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা এক সঙ্গে করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীকে দেবেন। আজ এ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার (আইকাও) বেঁধে দেয়া ২৪শে নভেম্বরের মধ্যে সৌদি আরবে ২১ লাখ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে চার লাখ এবং মালয়েশিয়াতে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি এমআরপি দিতে হবে। এর অন্যথা হলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে আসতে হবে। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মাথাব্যথা চরমে উঠলেও অনেকটা ঘুমুচ্ছে আউটসোর্সিং কোম্পানি আইরিশ।