সংগ্রামী কুলসুমা আক্তারের বদলে যাওয়া জীবন কাহিনী
জুবের সরদার দিগন্ত, দিরাই প্রতিনিধিঃ সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের জগদল গ্রামের কিশোরী বধু কুলসুমার জীবন সংগ্রাম শুরু হয় তার ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পর থেকেই। কিশোরী কুলসুমা তখন বুজতো না স্বামী সংসারের গুরুত্ব, যার কারনে সংসারের লোকজনের নানা কথা শুনতে হতো তাকে, সে কখনো বুঝতো আবার কখনো বুঝতে পারতো না যে কথাগুলো তাকেই বলা হচ্ছে। খেলার চলে কেটে যাচ্ছিলো তার দিন রাত। বিয়ের চার পাঁচ বছর অতিবাহিত হবার পরও তার গর্বে কোনো সন্তান না আসাতেও তাকে সহইতে হয়েছে নানা অপবাদ। অবশেষে সে অপবাদ তেকে মুক্তি পায় বিয়ের প্রায় ছয় বছর পর একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে। সন্তান জন্ম দেয়ার পর শুরু হয় নতুন যন্ত্রনা। স্বামীসহ শশুর বাড়ির লোকজন চাপ শৃষ্টি করে যৌতুকের টাকার জন্য, কুলসুমার বাবা দরিদ্র তাই যৌতুকের টাকা না দিতে পারায় তার স্বামী তাকে বাপের বাড়ি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দূর্গাপুর গ্রামে পাটিয়ে দিয়ে কোথাকার এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে, তার জীবনে আবার শুরু হয় সর্বনাশা মানুষীক কষ্ট, না পারছে সে স্বামীর চাহিদা মতো যৌতকের টাকা পরিশোধ করতে না পরছে সতীনের সংসার করতে। এক পর্যায়ে সে তার ছয় মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তাকে না কোনো প্রকার যোগাযোগ। ২০০৬ সালে বিয়ের হবার পর ২০১১ সালে তাকে চলে আসতে হয় তার বাবার বাড়িতে। হতদরিদ্র বাবা কয়েক মাসের মধ্যেই তার ও তার সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে অপারগতা জানালে সে হয়ে পরে দিশাহারা। এর পর প্রায় আড়াই বছর অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো মতে তার সন্তানের জীবন রক্ষার মতো খাবার সংগ্রহ করতে পরতেন কুলসুমা আক্তার, প্রতিনয়ত করে যাচ্ছিলেন তিনি জীবনের সাথে যুদ্ধ। এভাবেই কুলসুমা আক্তার এ প্রতিবেদককে জানান তার বদলে যাওয়া জীবনের কাহিনী। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বিয়ের পর ৫ থেকে ৬ বছর ছিলেন তার শশুর বাড়িতে, সেখান থেকে ৬ মাসের সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে আসতে হলো আবারো তার বাবার বাড়িতে। সেখানে এসেও সে শান্তি পায়নি তিন চার মাস পর শুরু করতে হয় অন্যের বাড়িতে কাজ। সারাদিন কাজের বিনিময়ে কখনো মিলতো এক প্লেইট ভাত আবার কখনো মিলতো এক কৈটা চাল আবার কখনো ১০ থেকে ১৫ টাকা তা দিয়ে কোনো মতে চলেতো তার ও তার সন্তানের জীবিকা। তিনি বলেন, প্রচন্ড ¯্রােতে শুধুমাত্র শিকর দিয়ে মাটিতে আকরে থাকা বৃক্ষের মতো অসহায় মনে হতো নিজেকে। আমি সব সময় ভাবতাম এই বুঝি আমার জীবনের অবসান হলো। এর পর ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে ইইপি/সিঁড়িঁ উন্নতি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হই আমি। তার পর থেকে প্রকল্পের প্রতিটা পোগ্রামে উপস্থিত থাকতাম আমি। প্রকল্পের প্রশিক্ষণ গ্রহন করে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাই আমাকে দু’কিয়ার জমি লিজ নিয়ে দিতে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ আমাকে ৬ হাজার ৫শত টাকা দিয়ে দু’কিয়ার জমি লিজ নিয়ে দেন। তার পর শুরু হয় নতুন প্রতিবন্ধকতা। এলাকার প্রবীন লোকজন বলতে থাকেন আমি এসব করতে পারবো না, আর তাছাড়া মেয়েরা হাওরে কাজ করলে তাদের মান-সম্মানের হানী হবে। আমি এলাকার প্রবীন ব্যাক্তিদের বুঝাতে সক্ষম হই, তাদের বুঝাই এতে কোনো প্রকার সমস্যা হবে না। সে জমিতে আমি ধান রুপনের কাজ শুরু করি, প্রতি দিন রোজের কাজের লোকের সাথে আমি নিজে জমির কাদায় নেমে কাজ করি। আর বৈশাখ মাসে আমি সে জমি থেকে ৪০ মন ধান উৎপাদন করি। আমার আর আমার সন্তানের মুখে ফুটে আনন্দের হাঁসি। এর পর সিঁড়িঁ উন্নতি প্রকল্প থেকে আমি সবজি চাষের জন্য মিষ্টি কুমরার বীজ, সার ও কিটনাশক পাই এবং পতিত জমিতে মিষ্টি কুমরার চাষ শুরু করি, এখানে সৃষ্টি হয় নানা প্রতিকুলতার, আমার টিমের সকল সদস্যদের নিয়ে সব প্রতিকুলতাকে জয় করে আমি মিষ্টি কুমরা চাষে বিপ্লব ঘটাই। পতিত জমিতে উৎপাধিত মিষ্টি কুমরা কিক্রি করে দলের প্রতিটা সদস্য ভাগে ৭হাজার ৫শত ৪০টাকা করে পাই। নিজের প্রচেষ্টায় বেগুন ও টমেটোর চারা উৎপাদন করে বিক্রি করে ৭হাজার ৫শত ৩০টাকা আয় করি। এবং আমি হয়ে যাই গ্রামের মেয়েদের আদর্শ্য। পরের বছর সিঁড়িঁ উন্নতি প্রকল্পের অর্থায়নে এক কিয়ার ও নিজের উপার্জিত টাকায় দু’কিয়ার জমি লিজ নেই আর সে জমি চাষ করে আমি ৬৫ মন ধান ঘরে তুলতে সক্ষম হই। পরে আমি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সেবাদানকারী সংগঠনের এল এস পি (লোকাল সার্ভিস প্রোপ্রাইটর) হই এবং দূর্গাপুর গ্রামের ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পাই। এখন আমি এলাকায় বাল্য বিবাহ প্রতিরোদের চেষ্টা করি, সবাইকে সচেতন হতে উদ্ভোদ্য করি, পরিস্কার পরিচন্ন থাকার কথা বলি এবং হাঁস-মুরগী ও গরু ছাগল পালনে উৎসাহিত করি।