‘মানুষের স্বাধীনতা সংকুচিত করে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়’
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এগিয়ে। হ্যাঁ, এমনটাই দেখা যাচ্ছে নানা তথ্য উপাত্তে। তাদের হাতেই অপহরণ, গুম এবং হত্যার অভিযোগ বেশি। অথচ তাদেরই তো মানবাধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি কাজ করা উচিত।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ১৬২ জন নিহত হয়েছেন। জানা যায়, ২০১৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪৮ জন আর ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। অর্থাৎ তিন বছরে মোট নিহত হয়েছেন ৪৮৯ জন। এদের অধিকাংশই নিহত হন পুলিশ ও র্যাব-এর হাতে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়াও এর মধ্যে পুলিশ ও র্যাব-এর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও আছে।
আসক-এর অন্য আরেরকটি হিসাব অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গত তিন বছরে নিখোঁজ ১৮৮ জনের মধ্যে ১১৫ জনের এখানো কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আর যাঁদের পাওয়া গেছে, তাঁদের বড় একটি অংশ, মোট ৩২ জনের লাশ পাওয়া গেছে।
২০১৩ সালে ৫৩ জন অপহৃত হয়েছেন। এদের মধ্যে পরে পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আর মাত্র দু’জন উদ্ধার হয়েছেন। অর্থাৎ ৪১ জনের কোনো খোঁজ আজও মেলেনি।
২০১৪ সালে একইভাবে অপহৃত হয়েছেন ৮৮ জন। এদের মধ্যে ২৩ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। উদ্ধার হয়েছেন ১২ জন আর ৪২ জনের কোন হদিস নেই।
এছাড়া চলতি বছরে এ পর্যন্ত অপহৃত বা নিখোঁজ হয়েছেন ৪৭ জন। এদের মধ্যে ছয়জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, জীবীত উদ্ধার হয়েছেন চারজন আর পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি ৩২ জন কোথায় আছেন, কেউ জানে না।
এর বাইরে হুমকি, সাংবাদিক নির্যাতন, দখলসহ আরো অনেক অভিযোগ আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে।
রাষ্ট্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারে না: সুলতানা কামাল
এ নিয়ে আসক-এর নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান আছে, তাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে খুন, গুম, অপহরণের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আমরা পাই।”
তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্র কোনোভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এইসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তাদের বিচার এবং জবাবদিহিতার আওয়তায় আনতে হবে।”
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘দেশের প্রতিটি নাগরিক আলাদাভাবে যখন নিরাপদে থাকেন, তখনই রাষ্ট্র নিরাপদ। আমরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়ে যে সংজ্ঞা দেয়, সেটি ভুল।”
তাঁর কথায়, ‘‘শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মানুষের স্বাধীনতা সংকুচিত করে ভালো রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।”
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷