কমলগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচন : বিএনপির মনোনয়ন চুড়ান্ত ॥ আওয়ামীলীগের আজ
বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চুড়ান্ত করেছে দলের হাইকমান্ড। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থী চুড়ান্ত হবে আজ সোমবার। গতকাল রোববার দুপুরে কমলগঞ্জ উপজেলা অডিটরিয়ামে উপজেলা ও পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি-সম্পাদকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি। উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ, কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি এম, মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দেক আলী, পৌর আওয়ামীলীগ সভাপতি মিফতাউল ইসলাম উপরু, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বকতিয়ার খান প্রমুখ। সভায় কমলগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় একক প্রার্থী চুড়ান্ত না হওয়ায় দুইজনের নামই দলীয় হাইকমান্ডে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা। আজ সোমবার কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র প্রার্থীর নাম চুড়ান্ত করবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের দুটি খসড়া তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া শনিবার রাতে ৭১টি পৌরসভার মেয়র প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত করছেন। কমলগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র পদে বর্তমান মেয়র ও কমলগঞ্জ পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু ইব্রাহিম জমশেদকে বিএনপি দলীয় একক প্রার্থী হিসেবে তালিকা প্রকাশ করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। তবে তৃণমুলের বিএনপি তা মানতে নারাজ। তাদের মতে তৃণমুলের বিএনপি থেকে এখনো একক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কমলগঞ্জে দলীয় আভ্যন্তরীন কোন্দলে জর্জরিত রয়েছে বিএনপি।
উপজেলা বিএনপি নেতা এম আবুল হোসেন জানান, আবু ইব্রাহীম জমসেদ বিএনপির কোন কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত নয়। তাঁর মতে বর্তমানে বিএনপি থেকে তিনজন প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী। তৃণমুলের সভা করে প্রার্থী চুড়ান্ত করা হবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রমতে, বিগত পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার পরও বিদ্রোহী হয়ে আরেক আওয়ামীলীগ নেতা প্রার্থী হওয়ায় দলকে চরম মূল্য দিতে হয়। ক্ষমতায় থেকেও তাদের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামীলীগ জয়লাভ করতে পারেনি। কমলগঞ্জ পৌরসভার সম্ভাব্য মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ে ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করেছেন। আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ১৯৯৭ সনে ৯.৮৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এলাকা নিয়ে কমলগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়। বর্তমানে কমলগঞ্জ পৌরসভার মোট ভোটার সংখ্যা ১১হাজার ৬শ ৬৮টি।
এবার দলীয় প্রতীকে প্রার্থী মনোনয়ন হওয়াই বিদ্রোহী হওয়ার সুযোগ না থাকায় সব দলের শীর্ষ নেতারা রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে। নেতাদের মতে, এবার তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারের মন জয় করতে মাঠে নেমে পড়েছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী নেতৃবৃন্দের মতে, এবারের নির্বাচনে বিদ্রোহী হওয়ার সুযোগ নেই। তারা বিগত নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার পৌরসভাসহ বিভিন্ন ইউপি নির্বাচনে তৃণমূলে অধিক জনপ্রিয় প্রার্থীকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে অটল থাকবেন। তাই এবার তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারের মন জয় করতে মাঠে নেমে পড়েছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তারা তৃণমূলের কার্যক্রম ঠিক রেখে হাই লেভেলে জোর তদবির ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
কমলগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র ও পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু ইব্রাহীম জমসেদ বিএনপির কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামীলীগ থেকে এককালের তুখোঁড় ছাত্রনেতা, থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, এড. এ,এস এম আজাদুর রহমান আজাদ, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ মো. আনোয়ার হোসেন, পৌর যুবলীগ সভাপতি ও সাপ্তাহিক কমলগঞ্জের কাগজ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক মো. জুয়েল আহমদ, জাতীয় পার্টি থেকে উপজেলা জাতীয় পার্টির সম্পাদক রফিকুল আলম, এছাড়া নাট্যাভিনেতা জাকারিয়া হাবিব বিপ্লব, প্রভাষক নজরুল ইসলাম, মাসুক আহমদ প্রমুখ নির্বাচনী মাঠে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আরো যাদেও নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন-কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব) এর সহধর্মিনী রওশন আরা, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র হাছিন আফরোজ চৌধুরী, বিএনপি নেতা এডভোকেট টিটুর নাম শোনা যাচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও পৌর এলাকার পাড়া-মহল্লায় সভা ও উঠান বৈঠক করে বেড়াচ্ছেন। বাজারের চায়ের দোকান ও গ্রামের দোকানগুলোতে এখনই গভীর রাত পর্যন্ত কে প্রার্থী হচ্ছেন, কে প্রার্র্থী হলে ভালো হবে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন।
মেয়র পদে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী কমলগঞ্জ পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতাকালীন সরকার মনোনীত পৌরসভা প্রশাসনিক কমিটির সদস্য, সাবেক ছাত্রনেতা, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতা, তৃণমূল কর্মী, সুশীল সমাজ ও সাধারণ জনগণ আমার পাশে আছে। তাদের মতের প্রতি সম্মান রেখেই নির্বাচন করার ইচ্ছা রয়েছে। প্রত্যাশা করি আমার যোগ্যতা ও অবস্থা বিবেচনা করে দলীয় সমর্থন পাব। একাগ্রতার সঙ্গে দলীয় কাজে সময় দিতে পারছেন আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়নসহ সাধারণ মানুষের জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। তিনি কমলগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দুর্দিনেও দলের পাশে ছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি পরপর দুইবার বিপুল ভোটে ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দল থেকে তাকেই মেয়র পদে প্রার্থী করা হবে বলে তিনি জোর আশাবাদী। আওয়ামীলীগের অপর প্রার্থী কমলগঞ্জ পৌর যুবলীগ সভাপতি, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ ও সাপ্তাহিক কমলগঞ্জের কাগজ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক মো. জুয়েল আহমদ সমকালকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন যাবত পৌর এলাকার দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সুখে-দু:খে কাজ করে গেছেন। সর্বোপরী দলের সকল প্রকার কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে কাজ করে গেছেন। আওয়ামীলীগ, যুবলীগ সহ সহযোগি অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ আমার সাথে আছেন। আমি জোর আশাবাদী দল থেকে আমিই মনোনয়ন পাব। এক প্রশ্নের জবাবে জুয়েল আহমদ বলেন, দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আবু ইব্রাহীম জমসেদ বলেন, সততা, ন্যায় বিচার ও উন্নয়ন-এই তিন ধারাকে অব্যাহত রাখতে আবারো মেয়র পদে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি বলেন, তার সময়কালে কমলগঞ্জ পৌরসভার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অপর প্রার্থী সাবেক মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাছিন আফরোজ চৌধুরী বলেন, জনগন আমার শক্তি। বিগত নির্বাচনে আমি পরাজিত হলেও হাল ছাড়িনি। পৌর এলাকার প্রতিটি সামাজিক সমস্যা সমাধানে আমি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি। জনসেবায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছি। এলাকার গরীব-দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি আবারো মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন। বিএনপি থেকে আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব) এর সহধর্মিনী রওশন আরার নাম শুনা যাচ্ছে নির্বাচনী এলাকায়।
কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এম, মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক রোববার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, জেলা আওয়ামীলীগ এর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে রোববার দুপুরে কমলগঞ্জ অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত তৃণমূলের সভা থেকে আওয়ামীলীগ থেকে দুইজন প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হবে। কেন্দ্র থেকে আজ রোববার একক প্রার্থীর নাম চুড়ান্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০০২ সনে প্রথম নির্বাচনে সাবেক এমএনএ মুহিবুর রহমান চাষী কমলগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান (মেয়র) নির্বাচিত হন। এ বছর ২৮ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান চাষী মৃত্যূবরণ করলে ৪ মার্চ ২০০৩ কমলগঞ্জ পৌরসভার উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই উপ-নির্বাচনে সাবেক ছাত্রদল নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হাছিন আফরোজ চৌধুরী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচনের তফশীল ঘোষণা করায় পৌরসভা নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নড়েচড়ে উঠে নিজের পক্ষে গণ সংযোগ শুরু করেন। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে বাসা বাড়িতে গিয়ে ও নানা কৌশলে প্রচার প্রচারনা করছেন। তাছাড়া হাট বাজারে ও চায়ের দোকানে ভোটারদের আপ্যায়ন করিয়ে নিজ প্রার্থীতার পক্ষে জানান দিচ্ছেন ও নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। অপরদিকে কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর পদে বর্তমান কাউন্সিলররা ছাড়াও আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর তরুন নেতাকর্মীরা কাউন্সিলর হিসাবে প্রচারনায় মাঠ সরগরম করতে দেখা গেছে। একই সংগঠনের একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে তদবির শুরু করেছেন। এসব সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে জনগনের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়াও বিভিন্ন কৌশলে প্রচারনা চালাচ্ছেন। অনেক সম্ভাব্য প্রার্থীরা ব্যানার আর বিলবোর্ডের মাধ্যেমে পৌর এলাকায় সর্বত্র পোষ্টার লাগিয়েছেন।