দেশে এখনো ৫১% মানুষ দরিদ্র : গবেষনায় তথ্য অক্সফোর্ডের

11920সুরমা টাইমস ডেস্কঃ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানসহ বিভিন্ন উপাদান বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ৫১ শতাংশেরও বেশি। গবেষনায় এমন তথ্য দিয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের ভিত্তিতে এটি নির্ণয় করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ১ দশমিক ২৫ ডলার মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

তবে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, শুধু মাথাপিছু আয় বা খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ দিয়ে দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র বিশ্লেষণ করা যায় না। এজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানসহ বিভিন্ন উপাদান বিবেচনায় নিতে হবে। আর এগুলোর ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ৫১ শতাংশেরও বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়ন উদ্যোগ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দারিদ্র্য পরিমাপে এক্ষেত্রে ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই)’ ব্যবহার করা হয়েছে।

এমপিআই নির্ণয়ে তিনটি মূল উপাদানের অধীনে ১০টি মানদণ্ড ব্যবহার করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। মূল তিনটি উপাদান হলো— স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের মানদণ্ড ধরা হয়েছে শিশুমৃত্যু ও অপুষ্টি। শিক্ষার মানদণ্ড স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়সীমা ও স্কুলে উপস্থিতির হার এবং জীবনযাত্রার মানের অধীনে রয়েছে বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, আবাসস্থলের মেঝে কাঁচা বা পাকা, রান্নার জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পত্তি। এগুলোর ভরযুক্ত (ওয়েটেড) গড় নির্ণয় করে দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দারিদ্র্যের গভীরতাও নির্দেশ করে এমপিআই।

গবেষণায় বলা হয়েছে, মানদণ্ড অনুযায়ী একজন ব্যক্তি কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ সুবিধাবঞ্চিত হলে তিনি বহুমাত্রিক দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কোনো ব্যক্তি যদি ২০-৩৩ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত হন, তাহলে তিনি দারিদ্র্যের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। আর ৫০ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত হলে চরম দরিদ্র অবস্থা বোঝায়। এছাড়া যাদের দুটি বা তার বেশি সন্তান মারা গেছে, পরিবারের কোনো সদস্য এক বছর ধরে বিদ্যালয়ে যায় না, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে বা যাদের কোনো সম্পত্তি নেই, তারা ‘নিঃস্ব’।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, উল্লিখিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এর মধ্যে ২১ দশমিক ৭ চরম দরিদ্র ও ১৭ দশমিক ২ শতাংশ নিঃস্ব। এছাড়া ২০ দশমিক ৪ শতাংশ দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ হলেও এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। দেশে দারিদ্র্যের তীব্রতা ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ।

বিবিএসের হিসাবের সঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দারিদ্র্যের হারের পার্থক্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মূলত মাপকাঠির ভিন্নতার কারণে দারিদ্র্যের হার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যেমন বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ২৫ ডলারের পরিবর্তে এখন ১ দশমিক ৯০ ডলারকে পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ হার বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ৫০ শতাংশের বেশিই হবে। তাই সংখ্যার বিচারে দারিদ্র্য দূরীকরণে ঝুঁকি থাকবেই। এক্ষেত্রে দারিদ্র্য দূরীকরণে টেকসই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেজন্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মাথাপিছু ১ দশমিক ২৫ ডলার হলো দারিদ্র্যের সীমা। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংক এ সীমা ব্যবহার শুরু করে। এ হিসাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সরকারি হিসাবে মাথাপিছু দৈনিক ২ হাজার ১২২ ক্যালরির কম গ্রহণ করলে তাকে দারিদ্র্য বলা হয়। সে হিসাবে ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে তা আরো কমে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে বলে জানায় বিবিএস।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মাথাপিছু খাবার গ্রহণ বা আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের যে হার বিবেচনা করা হয়, তা মূলত সীমানা নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে কারো দৈনিক আয় ১ দশমিক ২০ ডলার হলেও সে দরিদ্র। আবার দশমিক ৫০ ডলার আয় হলেও দরিদ্র। তবে দুটির গভীরতা ভিন্ন ধরনের। তাই এমপিআইয়ের মাধ্যমে এক্ষেত্রে দারিদ্র্যের হারের পাশাপাশি গভীরতা বোঝা যায়।

তিনি আরো বলেন, এমপিআই নির্ণয়ের পদ্ধতি কিছুটা জটিল। কারণ এক্ষেত্রে গুণগত বিভিন্ন মানকে সংখ্যায় রূপান্তর করতে হয়। তবে বিশ্বব্যাংকও আগের ১ দশমিক ২৫ ডলার মাথাপিছু আয় দ্বারা দারিদ্র্যের হার পরিমাপ পদ্ধতির পরিবর্তন আনছে। এক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তখন বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের সংজ্ঞা ও হার পরিবর্তন হবে।

অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্যের হারেও বাংলাদেশের সরকারি তথ্যের সঙ্গে এমপিআই সূচকের মিল নেই। বিবিএস বলছে, ২০১০ সালে শহর ও গ্রামে দারিদ্রের হার ছিল যথাক্রমে ২১ দশমিক ৩ ও ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। আর এমপিআই অনুসারে বাংলাদেশে শহর ও গ্রামে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৭ ও ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

এদিকে বিবিএস বলছে, দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠী রংপুর বিভাগে ৪২ শতাংশ। এর পর বরিশালে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ, খুলনায় ৩১ দশমিক ৯, ঢাকায় ৩০ দশমিক ৫, রাজশাহীতে ২৭ দশমিক ৪, চট্টগ্রামে ২৬ দশমিক ১ ও সিলেটে ২৫ দশমিক ১ শতাংশ। এমপিআই অনুসারে, দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী রয়েছে সিলেটে ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ। এর পর রংপুরে ৫৮ দশমিক ৯, বরিশালে ৫৬ দশমিক ৯, চট্টগ্রামে ৫১ দশমিক ৪, রাজশাহীতে ৫১ দশমিক ৩, ঢাকায় ৪৭ দশমিক ৭ ও খুলনায় ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, দারিদ্র্য পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকও তাদের পরিমাপক পরিবর্তন করছে। তবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণে ব্যয়িত অর্থকে বিবেচনা করে। এ হিসাবে দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৮। এর ভিত্তিতে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন পরিকল্পনাতেও এ তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই কোন দেশ বা সংস্থা কী তথ্য ব্যবহার করছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য হার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী ১০টি মানদণ্ডের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ দুর্বল অবস্থায় আছে বলে মনে করছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এদের মধ্যে স্কুলে ভর্তির হার ১৮ শতাংশ, স্কুলে উপস্থিতির হার আরো কম ১৪ শতাংশ। দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর শিশুমৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ আর অপুষ্টির হার ৩৪ শতাংশ। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৪০ শতাংশ ও ৩ শতাংশ নিরাপদ পানি পায়। আর দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশের ঘরের মেঝে পাকা, ৫০ শতাংশ রান্নার কাজে জ্বালানি তেল বা গ্যাস ব্যবহার করে ও ৩২ শতাংশের কিছু সম্পত্তি আছে।