ক্রিকেট অল স্টারের প্রথম খেলায় শেন ওয়ার্নের কাছে শচীনের হার

টসে দুই অধিনায়ক শচীন ও শেন ওয়ার্ন।
টসে দুই অধিনায়ক শচীন ও শেন ওয়ার্ন।

নিউইয়র্ক থেকে এনা: ক্রিকেট আল স্টারের তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম খেলায় লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের শচীন ব্যালাস্টারকে ৬ উইকেটে পরাজিত করেছে স্পীন জাদুকর শেন ওয়ার্নের ওয়ারিয়র্স। টসে জয় লাভ করে শেন ওয়ার্ন শচীন টেন্ডুলকারের দলকে ব্যাট করতে আমন্ত্রণ জানায়। শচীন টেন্ডুলকারের দল প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৪০ রান সংগ্রহ করে। দলের পক্ষে উদ্বোধনী জুটি বিরেন্দ্র সেহবাগ এবং অধিনায়ক টেন্ডুলকার মিলে করেন ৮৫ রান। এ জুটিকে যখন থামানো যাচ্ছিলো না, কোন বোলারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলো না, ওয়াসিম আকরাম থেকে শুরু করে সবাইকে পিটিয়ে বড় রান সংগ্রহের দিকে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই বল হাতে অভির্ভূত হন অধিনায়ক শেন ওয়ার্ন। তিনিই শচীনকে ঘিরে ফেরান অসাধারণ বল করে। শচীনের চমৎকার ক্যাচটি শূণ্যের উপর লাফিয়ে উঠে এক হাতেই লুফে নেন জ্যাক ক্যালিস। মূলত: শেন ওয়ার্ন, ড্যানিয়ে ভিক্টোরি এবং এন্ড্রু সায়মন শচীনের দলের ইনিংসের স্বল্প সংগ্রহে যবনিকাপাত ঘটান। শচীন এবং সেহবাগ যখন ক্রিজে ছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো শচীনের টীম রানের পাহাড় ঘটবে কিন্তু তার হতে দেননি শেন ওয়ার্ন। এই জুটির আউটের পর কোন ব্যাটসম্যানই দাঁড়াতে পারেননি। শেন ওয়ার্ন ২০ রানে ৩টি, ভিক্টোরি ১৩ রানে ১টি এবং সায়মন ১৫ রানের ৩টি উইকেট দখল করেন। শচীনের টিম থেমে যায় ১৪০ রানে। স্পীন কিং শেন ওয়ার্ন নির্বাচিত হন সেরা খেলোয়াড়।
প্রায় ৩৬ হাজার দর্শকে ঠাসা এই ম্যাচটি গত ৭ নভেম্বর দুপুর ১টায় অনুষ্ঠিত হয় নিউইয়র্কের সিটি ফিল্ডে। দর্শকরাও আসেন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, ওয়েস্টইন্ডিসসহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা হাতে। তাদের হাতে এবং গায়ের শোভা পায় শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরামসহ বিভিন্ন খোলোয়াড়ের ছবি এবং পেস্টুন। সে যাই হোক ১৪১ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে সাঙ্গাকারা, রিকি পন্টিং এবং জন্টি রোডসের অসাধারণ ব্যাটের উপর ভর করে ১৭.২ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যান শেন ওয়ার্নের দল। শচীনের দলের বোলারদের মধ্যে একমাত্র সফল ছিলেন শোয়েব আক্তার।
ক্রিকেট বিশ্বের দুই দিকপাল। একজন হলেন ভারত রত্ম এবং লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার এবং বিশ্বের সেরা স্পীন জাদুকর শেন ওয়ার্ন। দুই জনই দুই দলের অধিনায়ক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, বেইস বলে আক্রান্ত আমেরিকানদের দেশে আসর বসেছিলো ক্রিকেট ম্যাচের। তাও আবার মাত্র কয়েক দিন আগে বেইস বলের বিশ্ব সিরিজ হারা ম্যাটসের মাঠেই। আমেরিকা বলেই এটা সম্ভব হয়েছে যে, বেইস বলের মাঠের মধ্যভাগ চিরে বসানো হয়েছে পিচ। বেইস বলের মাঠেই ক্রিকেট ম্যাচ। বেইস বলপ্রেমীদের মাঠে ক্রিকেট প্রেমীদের উল্লাস এবং উচ্ছ্বাস। আটটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সর্বকালের সেরা প্রায় ৩০ জন খেলোয়াড়। সকাল ১১টায়ই খুলে দেয়া হয় সিটি ফিল্ডের বিভিন্ন গেইট। সত্যি কথা বলতে কী বেশিরভাগ দর্শকই ছিলেন এশিয়ান। তবে শচীন এবং ওয়াসিম আকরামের ভক্তই ছিলো বেশি। টস অনুষ্ঠিত হয় খেলা শুরু হবার ১ ঘন্টা আগে। টসে জয়লাভ করেন শেন ওয়ার্ন বল করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাট করতে নামের বিস্ময় বালক শচীন টেন্ডুলকার এবং ভারতের আরেক ড্যাসিং ওপেনার সেহবাগ। প্রথম বল করেন পাকিস্তান ও বিশ্বের এক সময়ের বিশ্বের সেরা বোলার ওয়াসিম আকরাম। ওয়াসিম আকরামের প্রথম বলে এক রান নেন সেহবাগ। পরের বলেই শচীন একরান করে রানের খাতা খুলেন। ওয়াসিমের প্রথম ওভারেই শচীন টেন্ডুলকার প্রথম চার মারেন। এ ওভার থেকে আসে ৮ রান। পরের ওভার করে ডোনাল্ড। তার ওভারে প্রথম ছক্কা হাকিয়ে দর্শকদের আনন্দে ভাসান সেহবাগ। তার ওভার থেকে আসে ৭ রান। ওয়াসিম আকরামের পরের ওভার ছিলো অনেকটা রান শুন্য।
ডোনান্ডের পরের ওভারেই শচীন এবং সেহবাগ ১২ রান তুলে নেন। পরিবর্তন করা হয় বোলার। বল করতে আসেন কুটনী ওয়ালস। ওয়ালস ভাল বল করেন। পরেই ওভারের দায়িত্ব দেয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার আলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসকে। তার ওভার থেকেই সেহবাগ এবং শচীন আদায় করে নেন সর্বোচ্চ ১৯ রান। ভারতের এই দুই তারকা হাত খুলে খেলতে থাকেন। শচীনের চেয়ে সেহবাগ ছিলেন মারমুখী। ওয়ালসকে তার দ্বিতীয় ওভারেই তিনটি ছাক্কা হাকান সেহবাগ। সাত ওভারেই এই দুই ওপেনার সংগ্রহ করেন ৭৭ রান। রানের লাগাম টেনে ধরতেই বল তুলে নেন অধিনায়ক শেন ওয়ার্ন। কিন্তু সেহবাগ যেন দুর্দান্ত। মাত্র ২০ বলেই হাফ সেঞ্চুরি করেন। তাও বিশাল ছক্কা হাকিয়ে। শেন ওয়ার্নার সফলও হলেন। এক অধিনায়ক আরেক অধিনায়ককে আউট করলেন। ওয়ার্নের ওভারের শেষ বলে শচীনের অসাধারণ ক্যাচ ধরেন ওয়াসিম আকরাম। শচীনের পর পরই ড্যানিয়ে ভিক্টোরির বলে ৫৫ রান করে বোল্ড হন সেহবাগ। খেলায় উত্তেজনা কমে আসে। মাঠে হাজার হাজার দর্শকের উত্তেজনায় ভাটা পড়ে। ব্যাট হাতে মাঠে নামেন লক্ষণ এবং ব্রায়ান রানা। ভিক্টোরি তার প্রথম ওভারে মাত্র ২ রান খরচায় তুলে নেন মারমুখী ব্যাটসম্যান সেহবাগকে। লারা রানের খাতা খুলেন রানা ১ রান নিয়ে। ১ রান নিয়েই তাকে মাঠ ছাড়তে হয়। শেন ওয়ার্নের শিকারে পরিণত হন তিনি। ফাঁদে পড়েন এলবিডব্লিউর। দলের হাল ধরেন মাহেলা জয়বর্ধনে। তিন ওভারে তিন উইকেট হারিয়ে শচী মাস্টার্সব্যাটের রানের চাকা যেন কিছুটা থমকে যায়। শেন ওয়ার্ন বুঝিয়ে দিলেন তিনি এখনো হারিয়ে যাননি। তৃতীয় ওভারেই স্ট্যাম্পের জালে ফেলে লক্ষণকে ৮ রানের সাজ ঘরে ফিরিয়ে দেন। লক্ষণের দ্রুত উইকেট পতনে চাপে পড়ে শচীনের দল। মাঠে নামেন কার্ল হুপার। শেন ওয়ার্ন তার ৪ ওভারে ২০ রানের তিন উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি এখনো স্পীন কিং। অপর সফল বোলার ড্যানিয়েল ভিক্টোরি। তিনি চার ওভারে মাত্র ১৩ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন। দীর্ঘক্ষণ উত্তেজনাহীন খেলায় এন্ড্রু সায়মনের বলে বিশাল ছয় মেনে উম্মাদনা ফিরিয়ে আসেন। কিন্তু বিধিবাম পরের বলেই অজিত আগাকারের তালুবন্দী হয়ে ১৫ বলে ১৮ রান করে ফিরে যান। এন্ড্রু সায়মনের দ্বিতীয় শিকার জন কার্লহুপার। মাত্র ১১ রান করে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন। মাঠে নেমেই ছক্কা মারতে গিয়ে সাজ ঘরে ফিরেন মইন খান। তার ক্যাচ ধরেন জ্যাক ক্যালিস। ওয়াসিম আকরাম কোন উইকেট না পেলেও ৪ ওভারে মাত্র ২৬ রান দিয়েছেন। ডোনাল্ডের শেষ ওভারের প্রথম বলেই বিশাল ছক্কা মেরে পরেই বলেই ক্যালিসের হাতে ধরা পড়েন শেন পলক। সায়মন ২ ওভার বল করে ১৫ রান দিয়ে তিনটি উইকেট দখল করে নেন। তিনি করেন ১১ রান। মুলারিধরন ২ এবং এম্ব্রোস ১ রানের অপরাজিত থেকে খেলা শেষ করেন। শেন ওয়ার্নের দলের জন্য টার্গেট দাঁড়ায় ১৪১ রান। উইকেট পড়ে ৮টি। শচীনের দলের সর্বোচ্চ রান বরে সেহবাগ। তার সংগ্রহ ৫৫ রান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান আসে শচীনের ব্যাট থেকে ২৬।
১৪১ রানের টার্গেটে খেলতে নামেন শেন ওয়ার্ন ওয়ারিয়ার্সের জ্যাক ক্যালিস ও মেথু হাইডেন। বল হাতে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস শোয়েব আক্তার। শোয়েব প্রথম ওভারে ৭ রান দেন। যার মধ্যে জ্যাক ক্যালিসের চারের মার ছিলো একটি। অপরপ্রান্তে বল হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার শেন পলক। পলকের ওভারেই ক্যালিসের ২ চারে দুই ওভারে ১৫ রান। শোয়েব আক্তারের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলেই ম্যাথু হেইডেন মাত্র ৪ রান করে মঈন খানের হাতে ধরা পড়েন স্লিপে। এ ওভারের চতুর্থ বলেই মূলারিধনের অসাধারণ থ্রোতে ফর্মে থাকা জ্যাক ক্যালিসকে ঘরে ফেরান ১৩ রানে। দলের হাল ধরেন সাঙ্গাকারা ও রিকি পন্টিং। খেলায় উত্তেজনা ফিরিয়ে আনেন সাঙ্গাকারা। তিনি এম্ব্রোসের দ্বিতীয় ওভারেই পর পর দুটো ছক্কা হাকান। পন্টিংও থেমে ছিলেন না। শেন পলকের পরবর্তী ওভারেই একটি ছক্কা মারেন। মুলালিধনও রক্ষা পাননি। তাকেও ছক্কা মারেন রিকি পন্টিং। সাত ওভারে রিকি পন্টিং ও সাঙ্গাকারার ব্যাটে ভর করে রান দাঁড়ায় ৬৮। এ জুটি যেন শচীনের জন্য বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। শচীন বোলার পরিবর্তন করে শোয়েবকে নিয়ে আসেন। তার দ্বিতীয় বলেই সাঙ্গাকারা ৪১ রান করে ধরা পড়েন মাহেলা জয়বর্ধনের হাতে। ৪১ রান করতে তিনি ২৯টি বলের মোকাবিলা করেন। সাঙ্গাকারার আউটের পরই মাঠে নেমে মুলারিধরনের এলবিডব্লিউর শিকার হয়ে ১ রানের ফিরে যান এন্ড্রু সায়মন। এই ওভারটি ছিলো একমাত্র মেডেন ওভার। শোয়েব আক্তার ৪ ওভারে ২৫ রান দিয়ে ২টা উইকেট দখল করেন। শেন পলক ৪ ওভারে ৩০ রান দেন। পাননি কোন উইকেট। উইকেট পাননি এম্ব্রাসও। ৪ ওভারে তিনি দিয়েছেন ৩৬ রান। দলের পরাজয় নিশ্চিত জেনেও বল হাতে নেন অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকার। রান দরকার মাত্র ৬টি। জন্টিরোডস শচীনের দ্বিতীয় বলটিক পাঠিয়ে দেন দর্শক গ্যালারিতে। ৬ উইকেটে জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করে শেন ওয়ার্নের ওয়ারিয়র্স। রিকি পন্টিং অপরাজিত থাকেন ৩৮ বলে ৪৮ রানে আর জন্টিরোডস ১৪ বলে ২০ রান করেন।
তিন ম্যাচ সিরিজে শেণ ওয়ার্ন এড়িয়ে গেলেন ১-০ তে। আগামী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে হিউস্টনে এবং শেষ ম্যাচ লসএ্যাঞ্জেলেসে। ম্যাচ শেষে মাঠে উপস্থিত ৩৬ হাজার দর্শককে উদ্বিলিত করেন উভয় দলের খেলোয়াড়রা মাঠের চারিদিক প্রদক্ষিণ করে।
খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন শচীন টেন্ডুলকার, শেন ওয়ার্ন, শোয়েব আক্তার, সাঙ্গাকারা এবং সেহবাগ। সকলেই নিউইয়র্কের দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, প্রথম ম্যাচেই এত দর্শক আমাদের প্রত্যাশাকে হার মানিয়েছে। সৌরভ গাঙ্গুলির না আসা নিয়ে শচীন বলেন, সৌরভ পশ্চিম বঙ্গ ক্রিকেট এসোসিয়েশনের সভাপতি। জরুরী সভা থাকার কারণে তিনি আসতে পারেননি। আগামী ম্যাচে তিনি থাকবেন।