রাজনের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় : পুলিশ পাহারায় রাজনের বাড়ি
কাইয়ুম উল্লাসঃ কার্তিকের গভীর রাত। বাতাসে শীতের আমেজ বইছে। আকাশ ঘুটঘুটে কালো। এখানে নড়বড়ে টিনের ঘর ছিল। সদ্য প্রবাসী একটি সংগঠনের অর্থায়নে হয়েছে আধাপাকা একটি বাড়ি। সেই বাড়িটির বারান্দায় জ্বলছে ৬০ ওয়ার্ডের একটি বাল¡। নিস্তব্ধ বাড়ির ভেতরে শুয়ে আছে একটি ভীত পরিবার। বাইরে তিনজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছেন। এটি সিলেট শহরতলীর কান্দিগাঁও বাদে আলী গ্রামের শিশু রাজনের বাড়ি। মানুষ মারতে কামরুলের সব ‘সিস্টেমই’ (পদ্ধতি) জানা ছিল। সৌদি থেকে এই সিস্টেম সে রপ্ত করে দেশে এসেছিল। প্রভাবশালী ভাই আলী হায়দারের দাপুটে সে ও তার ভাইয়েরা ছিল হিংস্র। স্থানীয় গিয়াস মেম্বারের হাত ধরেই আলীরা পেয়েছিল এই অসীম ক্ষমতা। যে ক্ষমতার কারণেই সাপকে যেরকম পিটিয়ে মারা হয় খেলার ছলে, ঠিক সেরকমই শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে এই খুনিচক্র। খুনের পর রাজনের লাশ গুম করারও সাহস দেখিয়েছে খুনিরা। এমনকি তাদের ক্ষমতার হাত এতটাই নিপুণ যে, খুনের পরপরই মূল হোতা কামরুল দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে পুলিশকেও তারা প্রায় ম্যানেজ করে ফেলেছিল। তবে, প্রকৃতির রহস্যময় বেড়াজালে খুনিদেরই মুঠোফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও চিত্র রহস্য উন্মোচন করে। গণমাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এই নিষ্ঠুর খুনের ঘটনা। খুনি গ্রেফতারের দাবি ওঠে। একে একে ধরা পড়া খুনিরা। শুধু মূল খুনি কামরুল ইসলাম পালিয়েছিল সৌদিতে। সেখানে বাঙালিরা তাকেও ধরে ফেলে। কিন্তু কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। সব জটিলতা কাটিয়ে কামরুলকেও দেশে আনা হয়েছে। কামরুল এখন খাঁচায় বন্দি। কিন্তু তাকে যারা বিদেশ পালাতে সহযোগীতা করেছিল, তারা অনেকেই আÍগোপন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এরা রাজনের বাবাকে হুমকি দিচ্ছে। সে কারণেই প্রতি রাত ৮ টার পর থেকে সকাল পর্যন্ত রাজনের বাড়িতে এই পুলিশ পাহারা।
এলাকা ঘুরে জানা গেছে, যতই দিন যাচ্ছে তত রাজন হত্যা মামলাটি রায়ের দিকে গড়াচ্ছে। এদিকে, রাজনের পক্ষেও এলাকাবাসী খুনিচক্রের ছবি দিয়ে আবার পোষ্টার-ব্যানার দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়েছেন। কামরুলসহ উল্লেখযোগ্য সব খুনিরাই কারাগারে। তাই রাজনের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান জানান, কামরুলকে বিদেশ পালাতে সহযোগীতা করেছিল গিয়াস মেম্বারসহ আরও কজন। এ ছাড়া শুরু থেকেই ঘটনাটি আপোষে নেওয়ার জন্য কান্দিগাঁওয়ের খালেদ মেম্বার ও মুজিব মেম্বার তদবির চালান। তাদের কথা না শুনায় তারা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। টুকেরবাজারের গিয়াস মেম্বারও মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গিয়াস উদ্দিনের মুঠোফোনে কল দিয়ে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকতার হোসেন বলেন, রাজন হত্যায় একাধিক আসামি। বর্তমানে সবাই কারাগারে। বিচারও শেষের দিকে। তাই নিজ উদ্যোগেই শুধু রাতের বেলা রাজনের পরিবারকে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ।
আদালত সূত্র জানায়, সামিউল আলম রাজন হত্যা (১৪) মামলার প্রধান আসামি কামরুলসহ কারান্তরীণ ১১ আসামির উপস্থিতিতে ৩৮ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আদালত আগামী ২০ অক্টোবর ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ২৫ অক্টোবর যুক্তিতর্কের তারিখও নির্ধারণ করেছেন। আগামী ২৬ অথবা ২৭ অক্টোবর রাজন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিলেটের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিরা হচ্ছে-জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের পুত্র কামরুল ইসলাম (২৪), তার ভাই মুহিত আলম ওরফে মুহিত (৩২), শামীম আলম (২০), জাকির হোসেন পাভেল (১৮), আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪), চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫), জালালাবাদ থানার টুকেরবাজার ইউনিয়নের পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের পুত্র ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নুর মিয়া (২০), দুলাল আহমদ (৩০), আয়াজ আলী (৪৫), তাজ উদ্দিন বাদল (২৮), ফিরোজ মিয়া (৫০), আছমত আলী (৪২) ও রুহুল আমিন (২৫)। এর মধ্যে শামীম ও পাভেল বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
এসএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) রহমত উল্লাহ বলেন, রাজনের বাবাকে কেউ হুমকি দিলে তিনি থানায় জিডি করবেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত নিরাপত্তার জন্য পুলিশ পাহারা দেওয়া হচ্ছে।
গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে সামিউল আলম রাজনকে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।