কমলগঞ্জে চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ না হওয়ায় ক্ষোভ
বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) থেকে : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার চা বাগান সহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন পর্যন্ত জাতীয়করণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী। বাগানগুলোতে চা শ্রমিক সন্তানরা শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ উপজেলার বাঘাছড়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়, পদ্মছড়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধবপুর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়, মদনমোহনপুর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০১২ সালে ওই সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণও হয়েছে। ৩য় ধাপে রেজিষ্ট্রেশন ও জাতীয়করণের অপেক্ষায় এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও এলাকাবাসী প্রহর গুনছেন। বর্তমান সরকারের ঘোষিত নীতিমালা অনুসারে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি রেজিষ্ট্রেশন ও জাতীয়করণ না হওয়াতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের ভবিষ্যত গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যথাশীঘ্রই জাতীয়করণ করা হলে চা বাগানে ঝরে পড়া শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি যেমন বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশে চা বাগানের শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দ্রুত রেজিষ্ট্রেশন ও জাতীয়করণ করার দাবী জানিয়ে স্থানীয় চা বাগানবাসী ও শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষারতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এমপি সহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি বিদ্যালয় সরকারীকরণ করতে হলে ৩৩ শতাংশ জমি ওই প্রতিষ্ঠানের নামে থাকতে হয়। সরকারীকরণের উপযুক্ততা বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে সময় সরকারীকরণের ঘোষণা দিয়েছেন, তার ঠিক আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে ওই সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীর প্যারেড স্কয়ারে শিক্ষক সমাবেশে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। তিন পর্যায়ে একাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রথম ও ২য় পর্যায় শেষে ৩য় পর্যায়ে বেশ কিছু বিদ্যালয় জাতীয়করণ হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এখন পর্যন্ত জাতীয়করণ হয়নি। কমলগঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণের জন্য ডিও (চাহিদাপত্র) পাঠিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এদিকে অতিসম্প্রতি কমলগঞ্জ উপজেলা চা বাগানের অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্ব-উদ্যোগে ৩ দিন ব্যাপি বাংলা, ইংরেজী, গণিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেন উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০জন শিক্ষক-শিক্ষিকা অংশ গ্রহন করেন।
আলাপকালে কমলগঞ্জ উপজেলার বাঘাছড়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনুপম কুমার সিংহ জানান, ১৯৮৪ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১৫১ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে। পদ্মছড়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রোশন আলী জানান, ১৯৬৪ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১৫২ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে। মাধবপুর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সবিতা নুনিয়া জানান, ১৯৬৪ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে। মদনমোহনপুর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমন বণিক জানান, ১৯২০ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১৭০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে। চা বাগান বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, রেজিষ্ট্রেশন ও জাতীয়করণের আশায় দীর্ঘদিন যাবৎ চা বাগান কর্তৃপক্ষের নামমাত্র সম্মানীতে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। জাতীয়করণ না হওয়ায় আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সমাজের শিক্ষিত হয়েও আমরা সামাজিক মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করতে পারছি না। এজন্য অনেক শিক্ষক মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির যুগে আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সংসার চালাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা। কমলগঞ্জের চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ না হওয়ায় চা বাগানের শ্রমিক সন্তান ও বাগানের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের শত শত ছেলে-মেয়েরা সরকারি উপবৃত্তি সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে অবিলম্বে এসব বিদ্যালয় জাতীয়করণে এলাকাবাসী সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মনোরমা দেবী বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কমলগঞ্জের চা বাগানের বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার পঞ্চানন বালা বলেন, চা বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণে সরকার খুবই আন্তরিক। কাজ চুড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই ৩য় ধাপে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হবে।
কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান বলেন, এ উপজেলার চা বাগান সমুহের চা শ্রমিকরা শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই অগ্রাধকার ভিত্তিতে এসব বিদ্যালয়কে দ্রুত রেজিষ্ট্রেশন ও জাতীয়করণ করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।