দেশের একমাত্র লাল দূর্গার পূজা হয় রাজনগরে!

Red Durgaবিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ ঃ মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উদযাপিত হয় উপমহাদেশের একমাত্র লাল বর্ণের জাগ্রত দুর্গাদেবীর পূজা। প্রতি বছরের ন্যায় আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হবে ব্যাতীক্রমী এ পূজা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া প্রায় তিনশত বছর ধরে ব্যতিক্রমী এই পূজার আয়োজন হয়ে আসছে এখানে। দেশের আর কোথাও লাল বর্ণের দেবী দূর্গার পূজা হয় না। প্রতি বছর ষষ্ঠী থেকে দশমীর বিসর্জনের দিন পর্যন্ত পাঁচ দিনে দেবী দর্শনে লক্ষাধিক ভক্তের পদচারণায় নিভৃত এই গ্রামটি হয়ে ওঠে কোলাহল মুখর।
তবে এ বছর ১৮ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠাদি বিহীত পূজার মধ্য দিয়ে এ উৎসবের সূচনা করা হবে। বিগত বছর শারদীয় উৎসব ৫ দিনব্যাপী হলেও এ বছর তা বর্ষ পঞ্জিকার তিথি পরিবর্তনের কারণে ৪ দিন হবে। তিথি পরিবর্তনের কারণে একই দিন নবমী ও দশমী পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
দেবী দর্শনের জন্য উপমহাদেশের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তরা।
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার ও রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁও গ্রামে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে পালিত হয়ে আসছে ব্যতিক্রমী এই পূজার। সিলেট বিভাগ মতান্তরে দেশের অন্যতম একটি লাল দুর্গা মন্ডপ এটি। পূজা শুরু হলে রাজনগর উপজেলা সদরের কমলারাণীর দিঘির পূর্বদিক থেকে যানবাহন ও পুণ্যার্থীদের ভিড় শুরু হয়। অষ্টমী ও নবমী পূজার দিনে রাস্তায় এতো ভীড় থাকে যে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পুণ্যার্থীরা পায়ে হেঁটে পূজা মন্ডপ দর্শনে যান। প্রতি বছর পূজার সময় মহিষ বলির পাশাপাশি কয়েক শত পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। পাঁচগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, পূজা উদযাপন পরিষদের ওই ইউনিয়নের সভাপতি মিহির কান্তি দাশ মঞ্জু জানান, মূলত এটি পারিবারিক পূজা। পূজা পরিচালনাকারীদের মধ্যে তিনি এখন ষষ্ঠ পুরুষ। তার পূর্বপুরুষ স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস ধ্যানে বসে কুমারী পূজার মাধ্যমে লাল দুর্গার দর্শন পাওয়ার পর প্রতিবছর এখানে লাল দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি আরও জানান, প্রায় তিনশত বছর ধরে তাদের বাড়ির মন্ডপে লাল দূর্গার পূজা হচ্ছে। এখানে পূজা শুরুর পর থেকে একবারও বাদ পড়েনি। শুধু ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মূর্তি নির্মাণ করে পূজা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। সঞ্জয় দাস জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সীপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার আসামের কামরুপ-কামাক্ষ্যা বাড়িতে গিয়ে পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয় লোকজন তাকে একটি মেয়ে দেন। সর্বানন্দ দাস সেই মেয়েকে পূজা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে মেয়েটির রং বদলে লাল হয়ে ওঠে। মেয়েটির মধ্যে স্বয়ং দেবী ভর করেন। মেয়েটি তখন সর্বানন্দ দাসকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাও। আমি তোমাকে বর (আশীর্বাদ) দিব।’ সর্বানন্দ দাস তখন তার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাইলেন। দেবী তখন নির্দেশ দিলেন পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রঙ হবে লাল। সেই থেকে এখানে লাল বর্ণের মূতির পূজা হয়ে আসছে। ভক্তদের বিশ্বাস পাঁচগাঁও দুর্গাবাড়িতে স্বয়ং দেবী অধিষ্ঠান করেন। এটি জাগ্রত প্রতিমা। লাল বর্ণের দেবী মূর্তি দেশের আর কোথাও নেই। যে কারণে এই প্রতিমার কাছে ভক্তদের অনেক আশা-আকাংখা। দূর্গা পূজা মন্ডপকে ঘিরে আশেপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এখানে মেলা বসে। কয়েকশত দোকানে বেচাকেনা হয় খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি, বাঁশি, বেলুন, ঝুমঝুমি কতকিছু। এখানে আগত হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা তাদের নানা মানত নিয়ে ছুটে আসেন। কেউ হোমযজ্ঞ দেন, কেউ প্রদীপ ও আগরবাতি জ্বালান। কেউবা পশু বলি দেন। গত বছর পূজাতে প্রায় সাড়ে ৫০০ পাঁঠা, ৬টি মহিষ ও প্রায় ৭০০ জোড়া কবুতর দেবীর নামে বলি দেওয়া হয়েছে। এখানে একটি দুর্গা মন্ডপ, একটি নাট মন্দির, একটি যজ্ঞ মন্দির, একটি যাত্রী নিবাস, একটি ভোগ মন্দির, একটি ফুল নৈবদ্য রাখার ঘর, একটি শিব মন্দির এবং একটি পাকা ঘাটসহ পুকুর রয়েছে।