আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীরা নিরাপদ যে কারণে
মাঈনুল ইসলাম নাসিম : অস্ট্রেলিয়ার সিডনি কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগনে খুনাখুনির সাথে ঢাকা-রংপুরের ‘টার্গেট কিলিং’ যে ঘুনাক্ষরেও এক নয়, তা সম্ভবতঃ এখন আর কোন রাতকানা দিনকানাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। ঢাকা সিডনি অরিগন আর রংপুরের মাটি যেমন ভিন্ন, তার চাইতেও বেশি তফাত সিটি-টু-সিটি ঘটে যাওয়া মার্ডারের উদ্দেশ্য এবং প্রেক্ষাপট। ‘খুন হওয়া’ বা ‘খুন করা’র সাথে ‘খুন করানো’র মোটিভগত ব্যবধান গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী বাহাদুরেররা বুঝেও না বুঝার ভান করেছিলেন বলেই ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক খুন হবার পর ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে পার পাবার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।
চেজারে তাভেল্লাকে রাতের অন্ধকারে পরপারে পাঠানো হলেও রংপুরের মাটিতে জাপানী ট্যুরিস্ট হোসি কোনিও’র লাশ কিন্তু ফেলা হলো দিনে দুপুরেই। কারা কেন কী উদ্দেশে এই ‘সিরিয়াল কিলিং’ এর আশ্রয় নিয়েছে বা নিচ্ছে, তা অনুসন্ধান না করে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে অবাস্তব সব অযৌক্তিক স্ট্যাটাস-কমেন্টস দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার সফর বাতিলের ‘খবরের পেছনের খবর’ আর ‘ক্লুর পেছনের ক্লু’র পেছনে না দৌড়ে একশ্রেনীর সাংবাদিকরাও পেশাদারিত্বের মাথা খেয়ে আবেগ-ক্ষোভ-হতাশাকে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছেতাই লিখেছেন। অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় বাংলাদেশী নাগরিকরা যে আদৌ ঝুঁকিতে নেই, তা সংশ্লিষ্ট দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীরা জানলেও বোধগম্য হয়নি ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ কিছু বধির লোকজনের।
অনেকেই লিখেছেন, “আমরা কি এখন অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় আমাদের নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি করতে পারি না”? বাস্তবতা হচ্ছে, সিডনি বা অরিগনে কোন বাংলাদেশী বা বিদেশী নাগরিকের লাশ প্রয়োজন নেই স্থানীয় কোন অপশক্তির, যেমনটা প্রয়োজন ছিল ঢাকা বা রংপুরে। কেউ কেউ এমনও স্ট্যাটাস দিয়েছেন, “চালনি বলে সুইকে, তোর পাছায় ছিদ্র কেন”? আসলে বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে, তাতে নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়, সেই ‘সুই’ যদি বাংলাদেশ হয় তবে ‘সুইয়ের পাছার ছিদ্র’ মোটা করার দায় এড়াতে পারে না স্বয়ং বাংলাদেশ সরকার। অস্ট্রেলিয়ার চালুনে ‘গোয়েন্দা তথ্য’ আটকে যাবে এবং গিয়েছিল বলেই তারা তাদের সিকিউরিটি অফিসারকে ঢাকায় পাঠায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে। তাদের শংকাকে ‘জাস্টিফাই’ করতে ঢাকায় ‘টার্গেট কিলিং’ সম্পন্ন হলে কুল রক্ষা হয়নি যৌক্তিক কারণেই।
উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, নিউজিল্যান্ড কর্তৃক প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের উপর গোয়েন্দা নজরদারি করে আসার সংবাদ ক’মাস আগেই প্রচার হয়েছিল বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে। সংবাদটি যেহেতু সত্য ছিল এবং প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও যেহেতু অস্বাভাবিক নয়, সেহেতু ক্রিকেট টিমের সফরকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়া সরকারের শংকাকে উড়িয়ে না দিয়ে আরো গুরুত্বের সাথে নিতে পারতো বাংলাদেশ সরকার। তাছাড়া বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগ খুব ভালো করেই জানে যে, সরকারের চলমান ‘পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট’ বাস্তবায়নের কারণে দেশের অভ্যন্তরে যারা সন্তুষ্ট নয় তারা ছাড়াও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারলে বাইরের যেসব শক্তির লাভ, সবাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ঠিক আজকের এই সময়টির জন্য।
অস্ট্রেলিয়া থেকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র আরো জানাচ্ছে, বিশেষ গোয়েন্দা তথ্য পাবার বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন স্তরে অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভয়াবহ নেতিবাচক ধারনাও দিয়ে আসছিল দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশীদেরই একটি বিশেষ মহল। গোয়েন্দা তথ্য এবং বাড়তি প্রোপাগান্ডা যেমন ছিল, সেই সাথে অস্ট্রেলিয়ানদের স্পর্শকাতরতার আগুনে পানি ঢেলে দেবার কাজটি সমাধা হয় খোদ বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকেও। “জঙ্গী দমনে সরকার বদ্ধপরিকর” এবং “বহু জঙ্গী দমন করেছি, আরো করবো”- দেশে বিদেশে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় এই ক্যাটাগরির চরম আত্মঘাতী ফ্রিস্টাইল প্রচারণার মাধ্যমে সরকারের অতি উৎসাহী মহল কর্তৃক ‘খাল কেটে কুমির আনা’ আজকের এই পরিণতির জন্য বেশ খানিকটা দায়ী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগ জানুক আর নাই জানুক তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের টনক নড়ুক আর নাই নড়ুক, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ান গোয়েন্দাদের কাছে এমন নিশ্চিত তথ্যও রয়েছে যে, ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত প্রতিটি বিদেশী নাগরিকের গতিবিধি অনেক আগে থেকেই মনিটর করে আসছে দেশের ভেতরে অবস্থানরত আন্ডারগ্রাউন্ড বিশেষ নেটওয়ার্কের লোকজন। সক্ষমতার শো-ডাউন তারা নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছে ইতালীয়ান ও জাপানীজের রক্তের দাগে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাকে কলংকিত করার মধ্য দিয়ে। কঠিন বাস্তবতার নিরিখে সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষনে সিডনি বা অরিগনের খুনখারাবির সাথে ঢাকা-রংপুরের ‘টার্গেট/জাস্টিফাই’ কিলিংকে এক কাতারে ফেলে দেয়ার প্রবণতা শুধু বোকার স্বর্গে বসবাসের নামান্তরই নয়, আত্মঘাতীও বটে।