মৌলভীবাজারে শাবি’র ছাত্রী নুসরাত অপহরণের নেপথ্যে
মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারে শাবি’র ছাত্রী অপহরণ ঘটনাটি বাহ্যত অপহরণ হলেও, কথিত অপহারক ও অপহৃতার মধ্যকার সম্পর্ক এবং নেপথ্যের ঘটনাবলী আড়াল করাসহ সংগত কারণেই ধারণা করা হচ্ছে- “শাবি’র ছাত্রী” ও “শাবি’র শিক্ষক” এ দু’টি বিশেষণ প্রসূত প্রভাব খাটিয়েই ফাঁসানো হয়েছে কথিত অপহারককে। ঘটনাটি নিয়ে চলমান রয়েছে নানা নাটকীয়তা। অথচ, অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে- অপহরণ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আরও নানা ঘটনা ও নাটকীয়তা। কথিত অপহরণ ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি, নেপথ্যের ঘটনাবলী ও নাটকীয়তা। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- কথিত অপহারক রুকুনুজ্জামান খান মৌলভীবাজারের একজন ব্যবসায়ী। শহরের শমসেরনগর রোডস্থ মাইজপাড়াস্থিত মেসার্স খান এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী রোকুনুজ্জামান খান মৌলভীবাজার জেলা সদরের জগৎপুর গ্রামের সাজ্জাদুর রহমান খানের পুত্র এবং নুসরাতের খালাতো ভাই কুলাউড়া উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সৈয়দ আলতাবুর রহমানের শ্যালক। অপরদিকে, নুসরাত শারমিন কুলাউড়া উপজেলাধীন পৃথিমপাশা ইউনিয়নস্থিত রাজনগর গ্রামের মৃত ঃ আব্দুর রহিমের কন্যা এবং রুকুনুজ্জামানের দুলাভাই কুলাউড়া উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সৈয়দ আলতাবুর রহমানের খালাতো বোন। সৈয়দ আলতাবুর রহমানের খালাতো বোন ও শ্যালক হিসাবে রুকনুজ্জামান ও নুসরাত পরষ্পর তালতো ভাই-বোন। সেই আতœীয়তার সুবাদে বিগত ২০১০ সাল থেকে নুসরাতদের বাড়িতে রুকুনুজ্জামানের অবাধ যাতায়াত, নুসরাতের সাথে ঘনিষ্টতা, একপর্যায়ে প্রেম, অতঃপর ২০১৩ সালের ৮ জুন মৌলভীবাজারের কাজী ইউসুফ আলী সিরাজীর অফিসে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর মৌলভীবাজার শহরের কাশিনাথ রোডে বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু হয় রুকনুজ্জামান-নুসরাতের দাম্পত্য জীবন। নুসরাতের এক চাচা ড. সুবহান সিলেট শাবি’র শিক্ষক থাকায় ও নুসরাত সিলেট শাবি’র ছাত্রী থাকায় এবং সর্বোপরী আতœীয় সম্পর্কের সুবাদে পরবর্তীতে উভয় পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেন এবং লেখাপড়ার সুবিধার্থে রুকুনুজ্জামানসহ নুসরাতকে লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিলেটস্থ ড. সুবহানের নিজ বাসায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিয়ে যান। রুকুনুজ্জামানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মৌলভীবাজারে থাকায়, বাধ্য হয়েই তিনি মৌলভীবাজারে অবস্থান করতেন এবং একদিন অন্তর অন্তর সিলেটস্থ ড. সুবহানের বাসায় নুসরাতের সাথে অবস্থান করতেন। এভাবে সুখেই কাটছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের দাওয়াত পেয়ে নুসরাতকে নিয়ে তার পিত্রালয়ে যান রুকুনুজ্জামান এবং শ্বাশুরীর অনুরোধে নুসরাতকে সেখানে রেখে রুকুনুজ্জামান ফিরে আসেন মৌলভীবাজারে। আর, এ সুযোগ কাজে লাগান নুসরাতের ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসান। কদিন পর যখন নুসরাতকে নিয়ে আসার জন্য রুকুনুজ্জামান তার মা-ভাই-বোনকে নুসরাতের পিত্রালয়ে পাঠান। তখন, পরিবারের লোকজনসহ নুসরাতের ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসানই নুসরাতকে আসতে না দিয়ে রুকুনুজ্জামানের মা-ভাই-বোনকে সাফ জানিয়ে দেন “নুসরাতকে আর কোনদিন রুকুনুজ্জামানের সংসারে যেতে দেয়া হবেনা”। এ ঘটনার পর থেকে স্ত্রী নুসরাতকে উদ্ধারে রুকুনুজ্জামান নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু, নুসরাতের ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসানের কারণে তিনি নুসরাতের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারছিলেননা। এখান থেকেই নুসরাতের পরিবারের সাথে রুকুনুজ্জামানের বিরোধের সূত্রপাত। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে- পূর্ব থেকেই নুসরাত-রুকুনুজ্জামানের বিয়েকে কেন্দ্র করে রুকুনুজ্জামানের ভগ্নীপতি সৈয়দ আলতাবুর রহমানের সাথে নুসরাতের ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসানের বিরোধ চলে আসছিল। এ বিরোধের প্রতিশোধ নিতেই মাহমুদুল হাসান পরিকল্পিতভাবে নুসরাতের মাধ্যমে বিদেশ ভ্রমনে যাবার অজুহাতে রুকুনুজ্জামানের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ ধার নেন। কিন্তু, ওই ধার নেয়া টাকা যথাসময়ে ফেরৎ না দেয়াকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে চাচা মাহমুদুল হাসানের সাথে রুকনুজ্জামানের চরম বিরোধ বাধে- যা এখনও চলমান। এদিকে, শাবি’র ঈদের ছুটি শেষে নুসরাত পুণরায় সিলেটস্থ চাচা ড. আব্দুস সুবহানের বাসায় ফিরে যাবার পর, রুকুনুজ্জামানও ছুটে যান সেখানে। কিন্তু, ড. আব্দুস সুবহানও অবতীর্ণ হন মাহমুদুল হাসানের ভূমিকায়। ফলে, ড. আব্দুস সুবহানের সাথে তার ব্যাপক বাক-বিতন্ডার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বিফল মনোরথে মৌলভীবাজারে ফিরে আসেন রুকুনুজ্জামান। এ বাক-বিতন্ডার জের হিসাবে পরবর্তীতে নুসরাতকে বাদীভূক্ত করে সিলেটের এয়ারপোর্ট থানায় একটি মামলা (নং- ১৬, তাং- ২৪/৮/১৫ইং) দায়ের করা হয়। এরপরও স্ত্রী নুসরাতকে অন্তঃত একনজর দেখার আকুলতায় পরবর্তীতে আরও একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। এভাবে, বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে নিরুপায় রুকুনুজ্জামান শ্বশুর পরিবারের হাত থেকে স্ত্রী নুসরাতকে উদ্ধারে শেষমেষ মৌলভীবাজারের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে একটি পিটিশন (নং- ৬২/২০১৫ইং, তাং- ৪/৮/১৫) মামলা দায়ের করেন। এর প্রেক্ষিতে গত ১৮/০৮/১৫ইং নুসরাতকে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে উপস্থিত করলে আদালত তাকে নিজ জিম্মায় জামিন দেন। এরপর রুকনুজ্জামান গত ২০ আগষ্ট নুসরাতের চাচা শাবি’র শিক্ষক আব্দুস সোবহান ও ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসানসহ বাবুল চৌধুরী, সাকিব হাসান সাকিল, সাইদুল হাসান রাহেল, আব্দুর রশিদ এবং অজ্ঞাতনামা আরো ৪ জনকে আসামী করে মৌলভীবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ১নং আমলী আদালতে একটি মামলা (নং- ৫৬২/২০১৫ইং, তাং- ২০/০৮/২০১৫ইং) দায়ের করলে, আদালত তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মৌলভীবাজার মডেল থানাকে নির্দেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তার ডাকে গত ৭ আগষ্ট নুসরাতকে নিয়ে তার চাচা শাবি’র শিক্ষক আব্দুস সোবহান ও ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসান মৌলভীবাজার মডেল থানায় আসেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ী ফেরার পথে কয়েকজন সহযোগীর সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে রুকনুজ্জামান তার স্ত্রী নুসরাতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলে, নুসরাতের ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসান মাছুম রাজনগর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা (নং- ০৩, তারিখ- ০৭/০৯/১৫ইং) দায়ের করেন। এর প্রেক্ষিতে রাজনগর থানার পুলিশ নুসরাতকে উদ্ধার এবং সহযোগীগণসহ স্বামী রুকনুজ্জামানকে আটক ও আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরন করে। এরপর গত ১০ সেপ্টেম্বর তাদেরকে ২ দিনের রিমান্ডে নেয়। স্বামী রুকুনুজ্জামান কর্তৃক স্ত্রী নুসরাতকে উদ্ধারের ঘটনাটি বাহ্যত অপহরণের ঘটনা হলেও, ঘটনাটি ঘটেছে স্ত্রী নুসরাতের অনুরোধেই। থানায় আসার পর স্ত্রী নুসরাতই তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্য কৌশলে স্বামী রুকুনুজ্জামানকে অনুরোধ পাঠায়। এর প্রেক্ষিতেই স্বামী রুকুনুজ্জামান কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে স্ত্রী নুসরাতকে উদ্ধার করে নিয়ে যান বলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। তবে, এ তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। ঘটনাটি নিয়ে পুলিশের ভূমিকাকেও রহস্যজনক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রায়ই অপহরণের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ তা আমলেই নেয়না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হয়। পুলিশী সহায়তা না পেয়ে অধিকাংশ ভূক্তভোগী আদালতে মামলা দায়েরে বাধ্য হন। অথচ, এ ঘটনায় পুলিশ আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল। মিডিয়ার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল অপহারক ও অপহৃতার মধ্যকার স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ও। অপহরণ ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলেও, কথিত অপহৃতা নুসরাত, তার চাচা ড. আব্দুস সোবহান ও মাহমুদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তাদের পক্ষীয় একটি সূত্র জানিয়েছে- তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজী নন। অপরদিকে- কথিত অপহারক রুকুনুজ্জামানের পরিবারের দাবী- তাদর গৃহবধু নুসরাতকে জিম্মি করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শাবি’র শিক্ষক চাচা ড. আব্দুস সোবহান ও ব্যাংকার চাচা মাহমুদুল হাসান এসব করছেন।
রাজনগরে শাবি ছাত্রীকে ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ : ১০ ঘন্টা পর সিলেট থেকে উদ্ধার