একটি প্রতিষ্ঠিত আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)
আখতার হোসাইন জাহেদ: স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জাতির জন্য এক অপার সম্ভাবনা। জাতির সম্ভাবনাময় এ বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বপ্ন ছিল অনেক পুরনো। যুগযুগ ধরে দেশের আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ, ছাত্র-শিক্ষকসহ ইসলামপ্রিয় জনসাধারণ এমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেছেন, দাবি তুলেছেন এমনকি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, আন্দোলন সংগ্রামের নায়ক-মহানায়ক, সংগঠক ও কর্মীদের অনেকেই আজ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। তাদের মধ্যে অন্যতম উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামিল শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)। মূলত জাতির সামনে এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা প্রথমে উত্থাপন করেন মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। ১৯১৯-১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত “দৈনিক যামানা” পত্রিকায় “আরবি ইউনিভার্সিটি” শিরোনামে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ধারাবাহিক কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে জাতির সামনে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, দাবি জানান। এরপর থেকে এ দাবির স্বপক্ষে সময় সময় যুগে যুগে সোচ্চার ছিলেন অনেকে। কিন্তু সব কালেই এ দাবিটি ছিল উপেক্ষিত ও অবহেলিত।
কালের পরিক্রমায় ২০০৬ সাল, শুরু হলো মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের নতুন ষড়যন্ত্র। এ দেশ থেকে মাদরাসা শিক্ষা মুছে ফেলার নীল নকশা আঁকতে শুরু করল কিছু কু-চক্রি মহল। এমনকি সে সময় মাদরাসা শিক্ষা নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে নিমজ্জিত হল। তৎকালীন সরকার ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিকে উপেক্ষা করে একই সালের ২৪ আগস্ট মন্ত্রীসভার বৈঠকে ফাযিল ও কামিল মাদরাসাগুলিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করে ফাযিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের সমমান প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এমন খবর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর কাছে পৌঁছলে তিনি রাগে, ক্ষোভে অগ্নীশর্মা হয়ে উঠলেন। তিনি বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট থেকে বলিষ্ট কণ্ঠে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে কর্মসূচি ঘোষণা করলেন মাঠে-ময়দানে। এ যেন এক সিংহের গর্জন, “মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংস হতে দেবোনা। আলিম-উলামা কর্তৃক তিলে তিলে গড়ে উঠা মাদরাসাগুলো রক্ষা করবোই, অক্ষুন্ন রাখবোই এর স্বকীয়তা।” তিনি সভা-সমাবেশ, ওয়াজ-নসিহত, সেমিনার-সেম্পোজিয়ামে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে জনসাধারণকে জাগিয়ে তুললেন আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির পক্ষে। ২৮ আগস্ট তাঁরই নির্দেশে বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ সিলেট মহানগরীর সিটি পয়েন্টে স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে মাদরাসার ফাযিল ও কামিলকে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের মান প্রদানের দাবিতে এবং মাদরাসায় ৩০% মহিলা শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে আহবান করে মহা-সমাবেশ। সমাবেশ থেকে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি কঠোর আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। কর্মসূচী ঘোষণা করলেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করবেন। তার এ দাবি-আন্দোলন তখন সার্বজনীন হয়ে উঠে ক্রমে। দেশ-বিদেশ থেকেও এ দাবি আদায়ের আন্দোলনে শরীক হন অনেক ধর্মপ্রান সচেতন মানুষ।
পূর্বঘোষিত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬ই,ং আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক স্বরণীয় দিন। যামানার শ্রেষ্ঠ মুযাদ্দিদ আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র আহবানে তাঁর মুরিদীন, মুহিব্বীনসহ ইসলাম ও মাদরাসা শিক্ষাদরদী জনসাধারণের সহ¯্রাধীক গাড়ীর বহর সকাল ১০টায় সিলেট থেকে ঐতিহাসিক লংমার্চ শুরু করল রাজধানী ঢাকার পথে। স্বরণকালের সর্ববৃহৎ লংমার্চটি সেদিন কোন প্রকার বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই বিকেলে পৌঁছল রাজধানীতে। বাদ আছর বায়তুল মুকাররামের উত্তর গেটে মহা সমাবেশের জনসমুদ্রে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ দৃপ্ত কন্ঠে বক্তব্য রাখলেন। তৎকালীন সরকারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি বহুদিনের, এ দাবি পূরণে বাঁধা কোথায়? টাকার অভাব থাকলে আমি দেব, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে দিন, নতুবা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছাড়া আমরা ঘরে ফিরে যাবনা”। সেদিন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির যৌক্তিকতা জনমনে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। ঐতিহাসিক এ লংমার্চের খবরকে যখন দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো জোরে সোরে ফলাও করল। মুহুর্তেই এর প্রভাব পড়ল পূরো দেশে, দেশের সচেতন সমাজে, টনক নড়ল সরকারের। তখনকার প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষনিক আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র সাথে এ বিষয়ে বৈঠকে বসার অনুরোধ জানালে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তার ছোট ছাহেবজাদা আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ও দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা কবি রুহুল আমিন খানকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। একান্ত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হলে বললেন, “পীর সাহেব আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম”। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী তিনি তার কথায় অটল থাকতে পারলেন না। তার সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা মাদরাসা শিক্ষা বিরোধীরা তা মানতে পারল না। এদিকে ছাহেব কিবলাহর প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া দেশের ইসলামী সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলোকে একত্র করে “সর্বদলীয় ইসলামী ছাত্রঐক্য” গঠন করে এ দাবিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিলে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী মাদরাসার ফাযিল ও কামিলকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ন্যাস্ত না করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অধিভূক্ত করলেন।
কিন্তু এখানেই থমকে দাঁড়ায়নি ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। তিনি ২০০৮ সালে ইন্তেকাল করলেও এ আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে রেখেছেন তারই রেখে যাওয়া ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী-সিপাহসালারেরা। বিশেষ করে তারই কনিষ্ট পুত্র ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী এ দাবির পক্ষে আরোও আন্দোলনমূখর হয়ে উঠলেন। সর্বশেষ এ বিষয়ে আমি তার বজ্রধ্বনি শুনেছি গত ৬মে ঢাকার বায়তুল মুকাররামের ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে বালাকোট সম্মেলনে। সেদিনও তিনি পিতার যোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবে হুংকার ছেড়েছিলেন। যদিও ইতিমধ্যে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৩ সংসদে পাস হয়েছে। তিনি বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, “শুনুন, আজ সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র অনুসারীরা যদি জেগে উঠে তাহলে এই শাপলা চত্ত্বর হেফাজতের শাপলা চত্ত্বর হবে না। এটা হবে তরীকায়ে মুহাম্মদীর বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাকে স্নেহ করেন। তাই আমাকে অনেক দায়-দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। আমি একটি কারণে এ দায়-দায়িত্ব নেইনি যে, আমি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চাই। যদি আজ আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোন বানচাল হয় তাহলে আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমরা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া ঘরে ফিরবনা।”
আজ স্বপ্ন পূরণ হল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র। সফল হল তার সকল আন্দোলন সংগ্রাম। শতাব্দীকালের আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবির বাস্তবায়ন ঘটল বর্তমান সরকারের আমলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শতবর্ষের এ দাবির যথার্থতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে আন্তরিকতার সাথে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর “ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৩” মহান জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করে ২০১৫ সালে এসে এর কার্যক্রম শুরু করলেন। গত ২৩ আগস্ট ২০১৫ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রণালয় কর্তৃক এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও গবেষনার নবঅধ্যায়ের সূচনা করলেন। যার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ আনন্দের সাগরে ভাসছে, শুকরিয়া আদায় করছে মহান রাব্বুল আলামীনের, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে বর্তমান সরকারের।
লেখকঃ আখতার হোসাইন জাহেদ
সংগঠক,কামিল হাদিস (এম.এ)
ই-মেইল ধশযঃধৎলধযবফ@মসধরষ.পড়স