হবিগঞ্জের নামকরণ ও কিছুকথা : মহিবুর রহমান জিতু
সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যমন্ডিত ধনে-ধানে, জ্ঞানে, চা’য়ে সবুজে, ফুল,ফল ফসলে ভরা, শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্যে ঐতিহ্যের ধারক, সহস্র রুপে অপরুপে রুপসী, প্রকৃতির রুপ বৈচিত্রের লীলাভূমি, খোয়াই, শাখা বরাক, সুতাং, সোনাই, করাঙ্গী, ইছালিয়া, কুলিয়াছড়া, বেড়ী, শুটকী, কালনী, ভূইছড়া নদী ঘিরে বারাম, বেনকা, ঘোলডুবা, ঘুংগীজুরী, কাগাপাশা, মকা, দমদম বিল, ধুলকী বিল, মাকাল কান্দি, হাওর-বাওর, টিলা-সমতল আর রঘুনন্দন, সাতছড়ি, কালেঙ্গা, দিনারপুর, তরফ পাহাড় সুশোভিত চান্দপুর, আমু, নালুয়া, চাকলাপুঞ্জি, চন্ডিছড়া, জগদীশপুর, তেলিয়াপাড়া, দ্বারাগাও, দেওন্দি, নয়াপাড়া, পারকুল, রেমা, বালুমারা, বৃন্দাবন, মধুপুর, রশিদপুর, লালচান্দ, লষ্করপুর, শ্রীবাড়ি, সুরমা, প্রভৃতি চা বাগানের পরিবেষ্টনে, পাহাড়-উপত্যকা সদৃশ খাল-বিল, নদী-নালা, গাছ-গাছালি, পুকুর-দিঘী, নি¤œজলা, ছড়াঝর্ণা, মাঠ-ঘাট, বিল-ঝিল, প্রভৃতি প্রান্তর আর নানান জাতের পশুপাখির সমাহারে পীর-আউলিয়া, সাধক-দরবেশ, ফকির-সন্ন্যাসী, কবি-সাহিত্যিক, বাউল-বৈরাগীর পদ¯পর্শে ধন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলানিকেতন হবিগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঐতিহাসিক সুলতানশীর হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা কবি সৈয়দ সুলতানের অধ:স্থল পুরুষ সৈয়দ হেদায়েত উল্লার পূত্র সৈয়দ হবিব উল্লাহ খোয়াই নদীর বাঁকে গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অতি প্রাচীনকালে । খোয়াই নদীর তীরে সৈয়দ হবিব উল্লার গড়ে তোলা বাজারটি ধীরে-ধীরে জমে উঠলে প্রথমে লোকে এটিকে হবিব ভাইর গঞ্জ বলে ডাকত । কালক্রমে বাজারটির নামকরণ হয়ে যায় হবিব গঞ্জ, পরে হবিব গঞ্জ থেকে হবিগঞ্জ ।
এককালে এ অঞ্চল তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল, ১. দিনারপুর রাজ্য, ২. বানিয়াচং রাজ্য, ও ৩. তরপরাজ্য । আবার একসময় ১৭৭৯ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের সাথে যুক্ত ছিল । ১৮৭৮ সালে হবিঞ্জকে প্রথম মহকুমা করা হয়, হবিগঞ্জ যুক্ত হয় সুন্দরী শ্রীভূমি সিলেটের সাথে । ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল পেরিয়ে স্বাধীনতার ১৩ বছর পর ১৯৮৪ সালের পয়েলা মার্চ মরহুম রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী হবিগঞ্জকে জেলা হিসেবে উদ্বোধন করেন ।
২৩ ডিগ্রি ৫৭ ইঞ্চি হতে ২৪ ডিগ্রি ৪২ ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১ ডিগ্রি ১০ ইঞ্চি হতে ৯১ ডিগ্রি ৪০ ইঞ্চি র্পূর্ব দ্রাঘিমাংশে হবিগঞ্জ জেলার অবস্থান । উত্তরে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা, পূর্বে মৌলভীবাজার জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা রয়েছে । হবিগঞ্জ জেলার আয়তন ২৬৩৬.৫৮ বর্গকিলোমিটার । ৮ টি উপজেলা, ৯ টি প্রশাসনিক থানা, ৬ টি পৌরসভা, ৭৭ টি ইউনিয়ন পরিষদ, ২২৮৪ টি গ্রাম ও ১২১ টি হাট বাজার নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ জনপদ আপন দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে কাল থেকে কালান্তরে।
হবিগঞ্জের সাহিত্য অঙ্গঁনে যারা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মহাকবি সৈয়দ সুলতান, শ্রী চৈতন্য দেব, মনসুর বয়াতি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবেন্দ্র কুমার পাল, যোগেন্দ্র চন্দ্র কুমার, শেখ ভানু, সিরাজ হক, দিনেশ রঞ্জন নাথ, আব্দুল মোছাব্বির ইবনে হাবীব, জাহান আরা খাতুন, সৈয়দা মমতাজ বেগম, মাওলানা শাহ্ শামছুদ্দিন আখঞ্জী ওরফে (আঞ্জব আলী আখনজী), জ্যোৎ¯œা চন্দ্র, মুহম্মদ রমজান আলী, আব্দুর রউফ চৌধুরী, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ছিদ্দিকুর রহমান, শাহ্ মুহম্মদ আরজান আলী, সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুস ছাত্তার, তরফদার মুহম্মদ ইসমাইল, ভূবন মোহন ভট্টাচার্য, আব্দুর রব চৌধুরী, প্রফেসর আফজাল চৌধুরী, এ কে শেরাম, পার্থ সারথী রায় চৌধুরী, মুহম্মদ আবুল বশীর বাঙ্গাল প্রমূক অন্যতম । বর্তমানে আমরা যারা সাহিত্য চর্চায় ব্রতী রয়েছি তাদের মধ্যে এস এম তাহের খাঁন, কামাল আহমেদ, রোমা মোদক, রাজু বিশ্বাস, অপু চৌধুরী, এম ফজলুর রহমান খালেদ, তাহমিনা বেগম গিনিসহ আরো অনেকে ।
প্রাকৃতিক স¤পদে সমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস, সিলিকা বালি, বনজ স¤পদ, চা ও
রাবার বাগান এবং মৎস স¤পদের বিশাল সমাহার ।
১৯৬০ ও ১৯৬৩ সালে রশিদপুর, শাহজীবাজার ও সাম্প্রতিক কালে নবীগঞ্জের বিবিয়ানায় গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে । যা দেশের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে রাখছে বিশেষ অবদান । মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজারের রেল স্টেশন থেকে তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশনের উভয় পাশে, রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে, চুনারুঘাট উপজেলার চন্ডীছড়া চা বাগানের আশে-পাশে যথেষ্ঠ পরিমান সিলিকা বালির
মজুদ রয়েছে ।
হবিগঞ্জ জেলার বনভূমির পরিমান ৮৭.৩৬ বর্গকিলোমিটার । চুনারুঘাট, মাধবপুর ও বাহুবলের এ বনাঞ্চলে সেগুন, শীলকড়ই, গর্জন, চাম, জাম, নাগেশ্বর, গামারী, বহেরা, হরিতকি, আমলকি, ছন-বাঁশ প্রভৃতি গাছ-গাছালির সমাহারে বাঘ, চিতাবাঘ, উল্লুক, বানর, হনুমান, হাতী, কাঠ বিড়ালী, খরগোশ, বন বিড়াল, বাগদাশ প্রভৃতি বন্যপ্রানীর অভয়ারন্যে- টিয়া, ময়না, ঘুঘু, ধনেশ, বন্য মোরগ, মথুরাসহ আরো অনেক প্রজাতির পাখির সুমিষ্ঠ কলতানে যে কাউকে আকৃষ্ট করে খুব সহজেই ।
১৮৫৪ সালে চা-য়ের আবাদ করা হয় জেলার চুনারুঘাট, মাধবপুর ও নবীগঞ্জের ৫৩৫১৯ একর ভূমিতে । জেলার ২৪ টি চা বাগান থেকে দেশের উতপাদিত মোট চা-য়ের ২৪ শতাংশ সরবরাহ করা হয় । দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে হবিগঞ্জের রাবার বাগানের অবদানও কম নয় । এছাড়াও হবিগঞ্জে রয়েছে দেশের বৃহৎ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র (শাহজীবাজার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র)। এতে সহজেই অনুধাবন করা যায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে হবিগঞ্জ জেলার অবদান কতটুকু ।
সুফী-সাধক, ওলি-আউলিয়াগনের তীর্থস্থান হিসেবেও হবিগঞ্জ জেলার রয়েছে গৌরবউজ্জ্বল পরিচিতি
। সিলেট বিজেতা হযরত শাহ জালাল (র.) এর প্রধান সঙ্গী সিপাহ্সালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (র.)
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে আগমনের ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা ।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তুঙ্গাচলের ঘরজামাই রাজা (রাজার মেয়ে বিয়ে করে রাজ্য লাভ) আচক নারায়ন তুঙ্গাচল থেকে বিতাড়িত হয়ে পালাবার পথে চুনারুঘাটের গাজীপুরে তরপ রাজকন্যাকে বিয়ে করে রাজত্ব লাভ করেন । তখন কাজিরখিল গ্রামে কাজী নূর উদ্দিন নামক একজন মুসলমান বাস করতেন । কাজী নূর উদ্দিন ছেলের বিয়েতে গরু জবাই করায় তরপরাজা আচক নারায়ন কাজী পূত্রকে হত্যা করেন । সিলেটে আচক নারায়নের ভগ্নিপতি গৌর গোবিন্দের পতনের পর তখন শাহ্ জালালের রাজত্ব চলছিল । কাজী পূত্র হত্যার সংবাদ সিলেটে পৌছলে হযরত শাহ জালাল (র.) সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (র.) এর নেতৃত্বে এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সেনা প্রেরণ করেন । খবর পেয়ে আচক নারায়ন তার রাজধানি জেলার চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর থেকে বাল্লা হয়ে ত্রিপুরার জঙ্গলে পালিয়ে যান । ১৩০৪ সালে চার হাজার সৈন্য ও বার জন আউলিয়া নিয়ে তরপ জয় করেন সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (র.)। পরবর্তীতে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ওলি আউলিয়াগন ছড়িয়ে পড়েন ইসলাম প্রচারের লক্ষে, এখনো ঐ অঞ্চল সমূহে তাদেও পবিত্র মাজার বিদ্যমান । চুনারুঘাটের মুরারবন্দেই রয়েছে সিলেট ও তরপ বিজেতা সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (র.) সহ বেশ কয়েকজন ওলি আউলিয়ার মাজার শরীফ । এখানে প্রতিদিন জেয়ারতের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অগনিত ভক্তের সমাগম ঘটে ।
ঐতিহ্যিকভাবেই এখানকার জনগোষ্ঠীরা অসাম্প্রদায়িক, মিশুক ও আতিথিয়তাপ্রিয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা মিলে-মিশে বসবাস করে আসছেন। মেলা-বান্নি, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন সবাই ।
মুক্তিযুদ্ধের উপসর্বাধিনায়ক এম এ রব, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী ড. এম এ রশীদ, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, আশার প্রতিষ্ঠাতা শফিকুল হক চৌধুরী, মেজর সি.আর দত্ত, সাবেক মন্ত্রী শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া, সাবেক মন্ত্রী এনামূল হক মোস্তফা শহীদ, বিখ্যাত হাড় বিশেষজ্ঞ ডা: আর আর কৈরীসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা দেশ মাতৃকা ও গণমানুষের জন্য অবদান রেখেছেন । যা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে ।
প্রকৃতির রানী হবিগঞ্জ জেলার গৌরবোজ্জ্বল আপন কীতির্ সমূহকে পুঁজি করে আগামী প্রজন্ম সাফল্যেও স্বর্ণশিখড়ে আরোহণ করবে, প্রাকৃতিক স¤পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে গড়ে তুলবে শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় রাখবে বিপ্লবী পদচারণা । সকল বাঁধা অতিক্রম করে উন্নতির এ ধারাবাহিকতা চলবে অনন্তকাল ।
সংগ্রহে: এম এস জিলানী আখনজী