ক্ষমার মহত্ব দেখিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত যে বাংলাদেশি
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন রইস ভূঁইয়া। কিন্তু এক বর্ণবিদ্বেষী মার্কিন তরুণ তাকে খুন করার জন্য গুলি করে। মরতে মরতেও বেঁচে যান তিনি। এখানেই শেষ নয় তার কাহিনী। বিচারে তার হত্যার চেষ্টাকারী তরুণের মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু রইস তাকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। এখন তার মিশন ক্ষমাসুন্দর একটি পৃথিবী বিনির্মাণ। বিদেশী পত্রিকা থেকে প্রতিবেদনটি এখানে তুলে ধরেছেন হাসান শরীফঃ
২০০১ সালে পেন্টাগন ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ারে আক্রমণের ১০ দিন পর রইস ভূঁইয়া নিজে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলেন। বাংলাদেশী এই অভিবাসী টেক্সাসের ডালাসে বাস করছিলেন। আরেকটু সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য মাত্র চার মাস আগে নিউ ইয়র্ক থেকে সেখানে চলে গিয়েছিলেন। এর বছরখানেক আগে তিনি অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিলেন। ২০০০ সালে যে কয়েক হাজার লোক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গ্রিন কার্ড লটারি বিজয়ী হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। অভিবাসী বন্ধুরা অবশ্য তাকে আগেই হুঁশিয়ার করে বলেছিল, টেক্সাসের স্থানীয় অধিবাসীরা কিছুটা বৈরী। রইস ভূঁইয়া তাদের কথায় কান দেননি। তার মন-প্রাণজুড়ে তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউকে নিয়ে এসে ঘর-সংসার শুরু করার বাসনা। এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা চাকরি আর থাকার জায়গা পাওয়ার আশ্বাস এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেখতে পেয়েই রইস ভাবলেন ডালাসই হতে পারে তার কাংখিত ঠিকানা। তার বয়স ইতোমধ্যে ২৭ হয়ে গেছে। নতুন জীবন শুরু করতে তিনি প্রস্তুত হয়ে গেছেন।
২১ সেপ্টেম্বর ভরদুপুরে টেক্সাকো স্টেশনে এক বন্ধুর হয়ে বাড়তি একটা শিফটে কাজ করছিলেন রইস ভূঁইয়া। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ছিলেন। ঠিক ওই সময়টাতেই মিনি-মার্টটিতে ঢুকলেন মার্ক স্ট্রম্যান। ন্যাড়া মাথার ও শরীরজুড়ে বর্ণবাদী নানা ট্যাটু লাগানো ৩১ বছর বয়সের চার সন্তানের জনক লোকটি মাদকাসক্ত এবং অনেক অপরাধ করেছেন। ৯/১১-এর পর ‘কোটি কোটি আমেরিকান যা করতে চাইতেন, তিনিও তা করতে চাইলেন : ১.২ মিটার দূর থেকে তার শর্টগান তাক করলেন প্রতিশোধ নিতে।
স্ট্রম্যান যখন তার ডবল ব্যারেলের বন্দুকটি নিয়ে দোকানটিতে প্রবেশ করছিলেন, তখন রইস ভূঁইয়া ভাবছিলেন, তিনি বুঝি দ্বিতীয়বারের মতো ডাকাতের কবলে পড়তে যাচ্ছেন। প্রথমবার ডাকাত তার কাছে একটি হ্যান্ডগান বিক্রি করার চেষ্টা করছিল স্থানীয়রা সবসময় তার কাছে টিভি, ঘড়ি এবং অন্যান্য চোরাই মাল বেচত। রইস ভূঁইয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত?’ লোকটা বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল নিলো। এবার রইস ভূঁইয়া ছিলেন প্রস্তুত। সতর্ক হয়ে তিনি ক্যাশ বাক্স খালি করে ফেললেন। বসের নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে মোটে ১৫০ ডলারের মতো নোট রইল। ‘স্যার, এখানে টাকা,’ বললেন রইস ভূঁইয়া। ‘প্লিজ, আমাকে গুলি করবেন না।’ স্ট্রম্যান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর দেশ কোথায়?’ দৃষ্টিকটু হলেও ১১ সেপ্টেম্বরের পর এটা অস্বাভাবিক কোনো প্রশ্ন ছিল না।
মাত্র এক দিন আগেও তিনি সেখানে সফট ড্রিঙ্ক আর স্ল্যাকস খেতে আসা কয়েকজন বন্ধুপ্রতিম পুলিশের সাথে ইসলাম ও ভূগোল নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওই সব পুলিশ প্রায়ই সেখানে আসতেন। তারা অবাক হয়ে বুঝলেন, আরবের বাইরেও অনেক লোক ইসলাম অনুসরণ করে। রইস ভূঁইয়া বিস্ফোরণের শব্দ শুনলেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, অনেক দূর থেকে আসছে, আশপাশের এলাকায় প্রায়ই এ ধরনের শব্দ শোনা যায়। তারপর তার দেহটি ছিটকে পেছনের দিকে গেল, মনে হলো তার মুখে ‘কোটি কোটি ভোমরা হুল ফোটাচ্ছে।’ দেখলেন তার ডান দিক থেকে কলের পানির মতো গল গল করে রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছিল, ‘আমার মস্তিষ্ক বুঝি আমার খুলি থেকে বের হয়ে আসবে। আমাকে বেরিয়ে আসা রোধ করতে হবে।’ তিনি দুই হাত দিয়ে পিচ্ছিল মাথাটা চেপে ধরলেন। ভাবলেন, ‘আমি আজই মারা যাচ্ছি?’ তারপর পড়ে গেলেন ডেস্কে।
মার্ক স্ট্রম্যান পরে পুলিশকে বলেছিলেন, তিনি আরবদের হত্যা করছিলেন। তার দাবি, তার এক বোন টুইন টাওয়ারে নিহত হয়েছে। অবশ্য এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রইস ভূঁইয়া ছিলেন তার তৃতীয় শিকার। এর আগে স্ট্রম্যান এক পাকিস্তানি ও এক ভারতীয়কে গুলি করেছেন। তারা কেউ আরব ছিল না। তাদের কেউ বাঁচেনি। দু’জন স্ত্রী আর ছয়টি সন্তান তারা রেখে গিয়েছিলেন। বাসুদেব প্যাটেল নামের ৪৯ বছর বয়স্ক ভারতীয়কে হত্যার জন্য বিচার হয়েছিল। সেটাও ছিল দোকানে। .৪৪ ক্যালিভার পিস্তল দিয়ে একেবারে কাছ থেকে গুলি করেছিলেন তিনি। বিচারকালে তিনি কোনো ধরনের অনুকম্পা প্রার্থনা করেননি। ২০০২ সালে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
রইস ভূঁইয়ার মুখ, খুলি আর চোখে মোট ৩৮টি গুলি লেগেছিল। তার স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় এবং সাথে সাথে তাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তিনি এখন কেবল আলোর ফুটকি দেখেন। গুলিগুলো চামড়ার নিচের স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হেনেছিল। তিনি এখনো ডান কাত হয়ে শুতে পারেন না, যন্ত্রণা অনুভব করেন। চুল ছাঁটার সময় ক্ষৈারকার সতর্ক না হলে তিনি কষ্ট পান। দু’টি গুলি সরানোর প্রক্রিয়া তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। চিকিৎসকেরা পুরনো দিনের ডেন্টিস্টের মতো সাঁড়াশি দিয়ে সে দু’টি তুলেছিলেন। সবচেয়ে বেশি তি হয়েছিল তার কপালের ডান দিকটা। ধর্মনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। সিজদার সময় ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠতেন। তার মা তাকে সবসময় বলতেন, তার মাথাটা খুব শক্ত। এবার তিনি তার প্রমাণ পেয়েছিলেন। তবে স্যুভেনির হিসেবে তিনি কোনো বুলেট রাখতে চাননি। স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের প্রক্রিয়া যখন এগোচ্ছিল, তখন রইস ভূঁইয়া সর্বোত্তমভাবে জীবন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তার গাড়ি ছিল না, টাকা নেই, লাখ লাখ ডলারের মেডিক্যাল বিল পড়ে আছে। তার যে বন্ধু ও চাকরিদাতা তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তিনিও তাকে এখন বোঝা মনে করতে লাগলেন। কিন্তু তবুও রইস ঘরে ফিরে যেতে আগ্রহী ছিলেন।
আমেরিকার স্বপ্ন স্পর্শ করতে তিনি বাংলাদেশে তার উচ্চসমাজ জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। মা-বাবাকে বলেছিলেন, তিনি আমেরিকায় সফল হবেনই। তারাও খুশিমনে তাকে তার ইচ্ছাপূরণ করতে দিয়েছিলেন। এ দিকে তার স্ত্রীও আর অপো করতে পারছিলেন না। ফলে বাংলাদেশে তার কিছু বাকি ছিল না। রইস ভূঁইয়া ডালাসেই রয়ে গেলেন। কোচে থাকতেন। বাইরে বেরোতে ভয় পেতেন অনেক দিন। সম্ভবত মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। কিন্তু মনোবিদ দেখানোর মতো পয়সা ছিল না। অনেক নামাজ পড়ার পর ২০০৩ সালে তিনি একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। লোকজনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এর চেয়ে ভালো উপায় আছে কি? তিনি ওলিভ গার্ডেনে কাজ শুরু করলেন। ইতোমধ্যে রেড ক্রস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তিনি ৯/১১ তহবিল থেকে সাহায্য পাওয়ার যোগ্য নয়। তারা তাকে খাবার ছাড়া অন্য কোনো ধরনের সহায়তা দিতে অস্বীকার করল। তিনি তাদের বিনামূল্যের খাবার দেয়ার সিদ্ধান্তও প্রত্যাখ্যান করলেন দৃঢ়ভরে। পরে এক বন্ধুপ্রতিম চিকিৎসকের সাহায্যে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ তহবিল থেকে চিকিৎসা বিল দিতে সম হলেন। বেশির ভাগ ঋণ শোধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুললেন, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন, ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করলেন, গাড়ি কিনলেন।
২০০৯ সালের মধ্যে তিনি যথেষ্ট সুস্থ হয়ে গেলেন। এবার তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে হজ করার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আল্লাহর কাছে, তা পূরণে মনস্থ করলেন। তার বাবা আগেই তিনবার হজ করায় তিনি তার মাকে নিয়ে মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা পুরো মাস লাখ লাখ লোকের সাথে মক্কায় ইবাদত করে কাটালেন। রইস ভূঁইয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে ডালাসে ফিরলেন। ‘আমি আর নিজেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম না’ পরে তিনি বলেছিলেন। ‘এর বদলে আমি মার্ক স্ট্রম্যানকে নিয়ে ভাবছিলাম। তিনি ৯ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায়।’ ‘সে তো আমারই মতো মানুষ,’ ভাবলেন রইস ভূঁইয়া। ‘সে একটা ভুল করেছে। সন্দেহ নেই, এটা ভয়ঙ্কর ভুল। তবে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তুমি যদি আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়ো, তবে তুমি হয় বিচার চাইতে পারো, কিংবা তুমি আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারো বা তুমি মাফ করে দিতে পারো। আর একবার তুমি মাফ করে দিলে, তার অর্থ দাঁড়াবে, সে মাফ পেয়ে গেছে, তাকে আর কারাগারে থাকতে হবে না। একবার আমি তাকে মাফ করে দিলে, তাকে আবার সাজা দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে? এটাই ইসলামের শিক্ষা। আমি সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। যে দুই নারী তাদের স্বামী হারিয়েছে, সে শিশুরা তাদের বাবাদের হারিয়েছে, তারাও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কিন্তু এখন মার্ক স্ট্রম্যানকে মেরে আমরা কিছুই পাব না। তাকে রক্ষা করতেই হবে।’
কখনো ভদ্রভাবে, কখনো হেসে হেসে, কখনো দক্ষিণ এশিয়ান নাকি সুরে রইস ভূঁইয়া স্ট্রম্যানের জন্য জনসমর্থন আদায়ের কাজ করে চললেন। ইন্টারনেটেও তিনি তার কাজ চালাতে লাগলেন। বিভিন্ন তহবিল সংগ্রহ অভিযানে নামলেন, বক্তাদের কথা শুনলেন, নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিক হ্যালপারিনের সাক্ষাৎ পেলেন। এই লোকটি টেক্সাসে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছিলেন। গত এক দশকে লন স্টার রাজ্যটিতে সহিংস অপরাধ কমতে থাকলেও মৃত্যুদণ্ড বেড়েই চলেছে। বছরে ২২টি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। মৃত্যুদণ্ডের আধুনিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ হার এটাই। হ্যালপারিন ইতঃপূর্বে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সহায়তায় ২০১১ সালের ১৬ মে রইস ভূঁইয়ার হজ এবং স্ট্রম্যানকে বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা করার প্রায় ১৮ মাস পর, ডালাস মর্নিং নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো :
‘বাংলাদেশ ইমিগ্রেন্ট সিকস স্টে অব এক্সিকিউশন ফর ম্যান হু শট হিম ইন ৯/১১ রিভেঞ্জ অ্যাটাক।’ রইস ভূঁইয়া লিখলেন, ‘আমি কয়েক বছর আগেই স্ট্রম্যানকে মাফ করে দিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, তিনি ছিলেন অজ্ঞ, ঠিক আর বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেননি। তা না হলে তিনি যা করেছেন, তা করতে পারতেন না।’ ‘আমি বিশ্বাস করি, স্ট্রম্যানের জীবন বাঁচানোর মাধ্যমে আমরা অবশ্যই তাকে উপলব্ধি করার সুযোগ দেবো। তিনি বুঝতে পারবেন, কোনো পরিস্থিতিতেই ঘৃণা শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে পারে না। এই সুযোগটি দেয়া হলে সম্ভবত তা তার ওপর এমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যে, তিনি ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে প্রচারকর্মী হতে চাইবেন।’ একটা সমস্যা ছিল : স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ঠিক দুই মাস আগে। তারিখটি নির্ধারিত ছিল ২০১১ সালের ২০ জুলাই। রাতারাতি রইস ভূঁইয়া আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব বনে গেলেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন, টিভি সাক্ষাৎকার, ব্লগ ও সংবাদ প্রতিবেদনের বিষয়ে পরিণত হলেন তিনি। কিন্তু স্ট্রম্যানের মৃত্যু ঠেকানোর কাজটি কিভাবে করবেন, তার কোনো সূত্র পেলেন না।
মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকায় তিনি নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। স্ট্রম্যানের আইনজীবী আর সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিতে লাগলেন। আইনের মারপ্যাঁচ আর লালফিতার দৌরাত্ম্যে সব সম্ভাবনা যখন ফিকে হয়ে যেতে বসেছে, তখন রইস ভূঁইয়া দেখা পেলেন খুররম ওয়াহিদ নামের এক আইনজীবীর। তিনি মামলাটি বেশ আন্তরিকতার সাথে নিলেন। ‘গ্রেস’ নামের একটি মৃত্যুদণ্ডবিরোধী গ্রুপের সাথে মিলে তিনি মামলাটি ক্ষতিগ্রস্তের অধিকারের যুক্তিতে আদালতে নিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। তারা তখন স্ট্রম্যানের সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করার একটা উপায় বের করার মরিয়া উদ্যোগ নিলেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার চূড়ান্ত সময়ের আগে রইস ভূঁইয়া কারাগারে গিয়ে স্ট্রম্যানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। স্ট্রম্যানের কার্যক্রম অনুসরণকারী ইসরাইলি চলচ্চিত্রকার ইলান জিভের সাহায্যে একটা ব্যবস্থা হলো। ইসরাইলি লোকটি তাকে জানালেন, স্ট্রম্যান এখন তার কাজ এবং বর্ণবিদ্বেষী আচরণের জন্য তীব্র অনুশোচনায় ভুগছেন। তিনি রইস ভূঁইয়ার নিঃস্বার্থ কার্যক্রমেও বিপুলভাবে অভিভূত। জিভ স্পিকারফোনের সাহায্যে কথা বলার প্রস্তাব দিলেন। রইস ভূঁইয়া তা গ্রহণ করলেন। তার আইনজীবী দল সেখানে সমবেত হলো। জিভ কথোপকথন রেকর্ড করলেন : ‘হাই ম্যান,’ স্ট্রম্যান তার ভারী কণ্ঠে বললেন, ‘আমার জন্য আপনি যা কিছু করেছেন, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার অন্তর থেকে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ ‘মার্ক, আপনার জানা উচিত আমি পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল আল্লাহর কাছে আপনার জন্য কী দোয়া করেছি। আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি, আপনাকে ঘৃণা করি না। আমি কখনো আপনাকে ঘৃণা করব না।…’ ‘হে রইস, তারা আমাকে বলছে, আমাকে এখনই ঝোলানো হবে। আমি এক মিনিটের মধ্যে আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করব।’ লাইনটি কেটে গেল। রইস ভূঁইয়া হতাশ হলেন। ‘আমি কখনো বলার সুযোগ পেলাম না, কেন আমি তাকে মাফ করেছি,’ তিনি আর্তনাদ করে বললেন। ‘আসল কথাটাই বলা হলো না। আমি বলতে পারলাম না। আমি এমনটা চাইনি।’ সন্ধ্যা ৮.৫৩-এ বিষাক্ত ইনজেকশনের মাধ্যমে মার্ক স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। এরপর ঘৃণা অপরাধের বিরুদ্ধে রইস ভূঁইয়ার জেহাদ নতুন মাত্রায় শুরু হলো। এর অংশ হিসেবে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড উইথআউট হেইট’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনেই তিনি কোথাও না কোথাও বক্তৃতা দিতে বের হন। তিনি স্ট্রম্যানের হতভাগা মেয়ে ও নাতিকেও সহায়তা করেন। স্ট্রম্যানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অন্য পরিবারগুলোর দিকেও হাত বাড়ান। বিভিন্ন দাতা আর স্বেচ্ছাসেবকদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করেন, ই-মেইলে নানা প্রশ্নের জবাব দেন, মিডিয়ার চাহিদা পূরণ করেন। স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার দুই মাস পর এক সাক্ষাৎকারে রইস ভূঁইয়া বলেন, ‘এখনো পথেঘাটে অনেক মার্ক স্ট্রম্যান আছে। এই দেশে এবং পৃথিবীতে অনেক ঘৃণা আছে। তুমি যদি আমার গায়ের রঙ, আমার ধর্ম, আমার কথা বলার ভঙ্গি পছন্দ না করো, তবে আমার করার কিছুই নেই, কারণ আমি এগুলো নিয়েই জন্মেছি, আমি এগুলো বদলাতে পারব না।’ তিনি তার জীবন কিভাবে চালাবেন তা নিয়ে সন্দেহের দোলাচলে রয়েছেন : তিনি কি তার লাখ ডলারের আইটি চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে তার ভাষায় তার জন্য ‘নিয়তি’ হিসেবে নির্ধারিত কাজে পূর্ণ সময় নিয়োগ করবেন? অবশ্য তিনি যে বার্তাটা ছড়িয়ে দিতে চান, সেটা স্পষ্ট : ‘অন্য লোকেরা ভিন্ন বলেই তাদের ঘৃণা করতে হবে, এমনটা যাতে কেউ ভাবতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যদি সত্যিই কোনো কিছুকে ঘৃণা করতে চান, তবে আচরণকে ঘৃণা করুন।’