৭২ ঘন্টার মধ্যে ৪২ বার

কি কথা তাহার সনে ?

Joyeeনুরুল হক শিপুঃ চার বছরের শিশু কন্যা স্নিগ্ধা দেব জয়ী। অপহরণ হয় প্রায় ১৭ মাস আগে। ২০১৩ সালের ২১ জুলাই সিলেট নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকার নবীন ৩৪/৩ বাসা থেকে বেলা ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যেই সে নিখোঁজ হয়। পুলিশ প্রশাসনের দীর্ঘ তদন্ত, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, আর জয়ীর মা-বাবার অভিযোগের তীর এখন একই গন্তব্যে। জয়ীর মা-বাবা বলছেন, জয়ীকে অপহরণ করে শংকর, অনিতা ও রবিউল নিঃসন্তান কোনো পরিবারের কাছে বিক্রি করেছেন। তাই তাদেরকে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জয়ীকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত ৩জনকে বাঁচাতে একটি মহল ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে। কারণ অভিযুক্ত ৩জনের সাথে বিরাট বড় একটি অপহরণকারী সিন্ডিকেটের সম্পর্ক রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্কুল শিক্ষক সন্তোস কুমার দেব ও সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাজস্ব শাখায় অফিস সহকারী শর্বানী দেব তুলির একমাত্র মেয়ে স্নিগ্ধা দেব জয়ী। আর জয়ীর বাবা সন্তোস কুমার দেবের বড় মামার ছেলে শংকর অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত। পুলিশ প্রশাসনের দাবি শংকর আর অনিতাই জয়ী অপহরণের মূলহোতা। তাদের আরেক সহযোগী হলেন, কাজিরবাজারের মাছ ব্যবসায়ী রবিউল। এদের মধ্যে জয়ী অপহরণ মামলায় শংকর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি গত ১১ নভেম্বর ফের একটি হত্যা মামলা কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেল হাজতে রয়েছেন। অনিতা ও রবিউল বর্তমানে জয়ী অপহরণের মামলা কারাভোগ করছেন। এছাড়া জয়ী অপহররেন দিন শংকর ও অনিতা একসাথে ছিলেন। তারা ভারতে একটি নাম্বারে ২জনই কথা বলেছেন। জয়ী অপহরণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে শংকর ও অনিতা একে অপরের সাথে ৪২ বার মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এমন তথ্য পুলিশ প্রশাসনের হাতে রয়েছে।
যেভাবে অপহরন : ২০১৩ সালের ১২ জুলাই জয়ীর বাবা সন্তোষ কুমার দেবের মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকার নবীন ৩৪/৩ নম্বর বাসায় আসেন জয়ীর মা-বাবা। সে বাসা থেকেই ২১ জুলাই হারিয়ে যায় চার বছরের কন্যাশিশু জয়ী। এরপর সিলেট কোতোয়ালী মডেল থানায় জিডি করেন জয়ী’র বাবা সন্তোস কুমার দেব। জিডিকে সামনে রেখে তদন্তে অগ্রসর হয় সিলেট কোতোয়ালী থানা পুলিশ।
নেপথ্যে: জয়ীর মা শর্বানী দেব তুলির পৈত্রিক নিবাস নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকায়। একই এলাকার বাসিন্দা জয়ী অপহরণে অভিযুক্ত শংকর। আবার শংকর হলেন জয়ীর বাবার বড় মামার ছেলে। জয়ীর মা তুলি ও বাবা সন্তুষের বিয়ে হোক তা চাননি শংকর। কারণ শংকর ভালবাসতেন তুলিকে। আর তুলি ভালবাসতেন তাঁর বর্তমান স্বামী সন্তোস কুমার দেবকে। জয়ীর বাবা সন্তোস কুমার দেব বলেন, ‘শংকর আমার মামাত ভাই। কিন্তু সে চায়নী আমার বিয়ে তুলির সাখে হোক। এরই জেরধরে সে আমার মেয়েকে অপহরণ করেছে। সে চায়নি আমরা সুখি হই। তিনি বলেন, শংকরের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অনিতার।’
অনিতা এবং অপহরন : নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকার গোপীনাথ আখড়ার সেবায়েত রামেন্দ্র ভট্টাচার্যের মেয়ে অনিতা ভট্টাচার্য। প্রায় ১০ বছর আগে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও আলীশারকুল এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চালক কিশোর ভট্টাচার্যের সাথে বিয়ে হয় তাঁর। অনিতা নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবিকার সহকারির দায়িত্ব পালন করতেন। বিবাহিত অনিতা স্বামীর বাড়িতে না থেকে বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ভাঙাটিকর এলাকার ইত্যাদি পয়েন্টে বাসা ভাড়া করে। ওই বাসায় তার সাথে প্রায়ই থাকতেন শংকর। অনিতা ২/৩ বছর নিরাময় পলিক্লিনিকে সেবিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওই হাসপাতালের ইন্টার্নি চিকিৎসক উজ্জলের। অবশ্য উজ্জল অনিতার বিয়েতে আর্থিক সহযোগীতাও করেছেন। বিয়ের আগে ভাঙাটিকর এলাকায় এক যুবকের সাথেও প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তাঁর।
জয়ীর বাবা সন্তোস কুমার দেব’র জিডিকে সামনে রেখে তদন্ত চলছিল। তবে তদন্তের অগ্রগতি ছিলোনা তেমন। জয়ী নিখোঁজের দীর্ঘদিন পর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় লামাবাজার পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ এসআই সিরাজুল ইসলামকে। এসআই সিরাজ মামলার তদন্ত শেষে গত ২৪ আগস্ট সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সোলেমানপুর গ্রামের আমির উদ্দিনের ছেলে কাজিরবাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. রবিউলকে গ্রেপ্তার করেন।
গ্রেপ্তারের পর রবিউল ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। রবিউল জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন শংকরের কোলে ‘তুলির বাচ্চা’কে দেখে তাঁর সন্দেহ হলে তিনি শংকরের পিছু নেন। শংকর শিশু জয়ীকে নিয়ে নৌকায় ওঠেন। নৌকাযোগে সুরমা নদী পেরোনোর পর শংকর শিশুটিকে তুলে দেন নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের নার্স ভাঙাটিকরের অনিতা ভট্টাচার্যের হাতে। তখনই শংকরের চোখ পড়ে রবিউলের দিকে। ভয়ে চমকে ওঠেন শংকর। তখন শংকর কাউকে কিছু না বলার জন্য রবিউলকে ২ হাজার টাকা দেন। এরপর রবিউল ফিরে আসেন শেখঘাটের বাড়িতে। পরদিন আবার শংরের সঙ্গে দেখা হয় রবিউলের। ওই দিন শংকর রবিউলকে আরো ৫ হাজার টাকা দেন। ওই দিনও তিনি রবিউলকে অনুরোধ করেন বিষয়টি যেন কাউকে না জানান। রবিউল ও শংকরের জবানবন্দি অনুযায়ী কললিষ্টের সূত্রধরে পুলিশ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার আলী শাহরকূল গ্রামে অভিযান চালিয়ে অনিতার স্বামী কিশোর ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করে। স্বামী কিশোরের তথ্যমতে পুলিশ অনিতার স্বামীর বাড়ি থেকে প্রায় ৭/৮ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল সীমান্তবর্তী রাবার বাগান এলাকার টিলার উপরে রতিশ বাবুর বাড়ি থেকে অনিতাকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশের কললিস্টে যা আছে: শিশু জয়ীকে অপহরণের পর শংকর ও অনিতার মোবাইালের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে, ওই দিন অনিতা ও শংকর বেলা ৪টা ৩ মিনিটে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় এক সাথে ছিলেন। এবং তারা ওই দিন ভারতের একটি নাম্বারে ২জনই তাদের মোবাইল ফোন থেকে কথা বলেছেন। এছাড়া জয়ী অপহরণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে অনিতা ও শংকর একে অপরের সাথে ৪২ বার কথা বলেছেন। পুলিশ বলছে, অনিতা ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, শংকরের কাছে জয়ী আছে। এবং জয়ী দেশের ভেতরেই জীবিত আছে।
অনিতার অভিযোগ মিথ্যা: জয়ী অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত অনিতাকে ৩ দিনের পুলিশ রিমান্ডে আনা হয়। অনিতার স্বামী কিশোর ভট্টাচার্য মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবরে অভিযোগ করেন, কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও এসআই হাসিনা আক্তার আঁখি মিলে অনিতার ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন করেন। কিন্তু কোতোয়ালী থানা একাধিক পুলিশ দাবি করেছেন অনিতার গায়ে পুলিশ হাত দেয়নি। এটি ছিলো তার সাজানো নাঠক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যে ৩দিন অনিতা রিমান্ডে ছিলেন, তাকে পুলিশের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মৌখিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জয়ী অপহরণের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একটি চক্র ওই নাঠক সাজায়। যে নাঠকে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে জয়ী উদ্ধার কার্যক্রম। জয়ীর বাবা সন্তোষ কুমার দেবও রিমান্ডে অনিতাকে অত্যাচারের বিষয়টিকে অনিতার নাঠক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সবুজ সিলেটকে জানান, অনিতাকে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আমার মেয়েকে ফিরে পাওয়া যাবে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা যা বলেন : এসআই সিরাজুল ইসলাম জানান, শিশু জয়ীকে উদ্ধারের শেষ প্রান্তে এসে একটি চক্র ঘটনাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করেছে। তবে জয়ী অপহরনের সাথে অনিতা ও শংকর জড়িত। তিনি বলেন, পুলিশের কাছে রবিউল, অনিতা ও শংকরের জাবানবন্দী রেকর্ড আছে। অনিতা আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচারকারী দলের সাথে জড়িত বলেও ধারণা করছে পুলিশ। তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত মামলার চার্জসিট দেয়ার সময় সীমা বেধে দেয়ার কারনে আমরা শিশু জয়ী উদ্ধারকার্য সম্পাদন না করেই আদালতে মামলার চার্জশিট দিতে হচ্ছে।