অভিভাবকহীনতায় দুর্ভোগে নাকাল সিলেট নগরবাসী
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী সিলেট এখন অনেকটাই অভিভাবকহীন। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলছে নির্বাচিত মেয়রবিহীন এই জনবহুল নগরী। ভেতরে বাইরে যেন সিটি করপোরেশন লাগামহীন।
চিরচেনা সিলেট নগরী ক্রমেই সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দিন দিন নগরীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যেখানে সেখানে ময়লার ভাগাড় আর ফুটপাত দখলের মধ্য দিয়ে শ্রী হারিয়ে নগরী এখন অনেকটাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। নগরীর খোঁজ নেবার যেন কেউ নেই। দ্বন্দ্ব মিটছে না সিসিক কাউন্সিলরদের। সবকিছুতেই যেন অগোছালো অবস্থা।
অল্প বৃষ্টিতেই সীমাহীন জলাবদ্ধতা। সিটি করপোরেশনের গেইট থেকে শুরু করে পুরো নগরীর ফুটপাত এমনকি কোনো কোনো স্থানে রাস্তার অর্ধেকজুড়ে হকারদের দাপট। কে শুনে কার কথা।
নগরবাসী বলছেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যা করতে পারবেন একজন সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে সেটুকু করা সম্ভব নয়।
পূণ্যভূমি সিলেট বিভিন্ন কারণে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে পরিচিত। ওলিকুল শিরোমনি হজরত শাহজালাল (রহ.) এবং হজরত শাহপরান (রহ.) এর মাজার, চা বাগান এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্পট থাকার কারণে প্রতিদিন সিলেট নগরীতে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসুর আগমন ঘটে। অনেকেই মনে করে থাকেন সিলেট নগরী নিজ সৌন্দর্যে মহিমান্বিত। কিন্তু সিলেটে এসেই সব ধারণা পাল্টে যায় পর্যটকদের।
যানজটে এখন স্থবির নগরী। ছুটির দিন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিদিনই নগরীতে যানজট লেগেই থাকে। যানজটের কবলে পড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে সুকৌশলে সিলেট নগরীকে সৌন্দর্যহীন করা হচ্ছে।
শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনে নগরীতে তীব্র যানজট কখনও দেখেননি নগরবাসী। তবে কেন এই যানজট? তবে কি সিলেটের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। নগরীর অধিকাংশ পয়েন্টে যানজট সৃষ্টি হলে ট্রাফিক পুলিশকে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যেন তাদের কিছুই করার নেই। দিনের বেলা নগরীতে ট্রাক প্রবেশ করলেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে কতিপয় অসাধু ট্রাফিক পুলিশ অর্থের বিনিময়ে এসব ট্রাক প্রবেশে সহায়তা করেন।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ময়লার ভাগাড় মানুষের যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছে। দুর্গন্ধে এসব এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষদের রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে পার হতে হয়। নগরীর রিকাবীবাজারে সিটি করপোরেশনের ময়লার ভাগাড় এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীদের জন্য বড় রকমের দুর্ভোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই দুর্গন্ধের মধ্যেই যাতায়াত করে।
এখানকার ময়লা ফেলার বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট ও দুর্ভোগের চিত্র ছাপা হলেও সিসিকের টনক নড়েনি। একই অবস্থা নগরীর শিবগঞ্জ ফরহাদ খাঁ পুলের সামনে। সেখানে সাময়িক সময়ের জন্য ময়লা ফেলার অনুমতি দেয় স্থানীয় এলাকাবাসী। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও ময়লা ফেলার স্থানটি পরিবর্তন করা হয়নি। রাস্তার উপর ময়লা ফেলে দুর্ভোগের সৃষ্টি করা হয়েছে। একই অবস্থা নগরীর ব্যস্ততম জিন্দাবাজার জল্লারপাড় রাস্তার মসজিদের পশ্চিমে, জামতলার রাস্তার মুখে।
সবচেয়ে করুণ চিত্র দেখা গেছে নগরীর দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা টার্মিনাল রোডের নছিবা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। বর্জে্যর ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে এ স্থানটিকে। বর্জে্যর দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করার কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলেও জানা গেছে। ওই স্থানে প্রতিদিন অপরিকল্পিতভাবে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে টার্মিনাল রোড দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণ ও পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নগরবাসীর অভিযোগ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাস্টবিন না থাকার কারণেই নগরবাসীকে এমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হলে নগরীর এমন চিত্র থাকতো না বলে বিশিষ্টজনদের অভিমত।
যানজটের অজুহাত দেখিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে রিকশা লেন। রিকশা লেন তুলে ফেলার সাথে সাথেই তা দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কতিপয় অসাধু পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতা-পাতি নেতাদের মধ্যে ফুটপাত ভাগ করে নেয়া হয়। নিয়মিত চাঁদা আদায় করে ফুটপাত এবং রাস্তার কিছু অংশ হকারদের দিয়ে দেয়া হয়। খোদ সিটি করপোরেশনের গেইটের সামনে থেকে পোস্ট অফিসের সীমানা পর্যন্ত রাস্তা অর্ধেকেরও বেশি হকারদের দখলে। কথিত নেতারা রয়েছেন ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে। ভাসমান হকাররা জানিয়েছে, টাকার বিনিময়েই তারা এখানে ব্যবসা করছেন।
তরকারি ব্যবসায়ী কামাল এই প্রতিবেদককে জানান, এখানে বসার জন্য তাকে প্রতিদিন ৫০ টাকা বখরা দিতে হয়। পুলিশও নিয়মিত চাঁদা নেয়। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় অস্থায়ী সিএনজি স্টেশনের জন্য। অসাধু কতিপয় ট্রাফিক পুলিশ অল্প টাকার বিনিময়ে সিএনজি চালকদের দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করার সুযোগ করে দেয়।
অভিযোগ রয়েছে গাড়িপ্রতি মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকা আদায় করে ট্রাফিক পুলিশ। যে কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় পথচারীদের।
এদিকে, বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার বছরখানেক পর কিবরিয়া হত্যা মামলায় আরিফুল হক চৌধুরী এখন জেলহাজতে। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়েই সিলেট নগরীকে সাজাতে মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করেন। নগরীর ছড়া খাল উদ্ধার এবং ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। নিজেই রাস্তায় নেমে হকারদের ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করেন। হকারদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন।
নগরীর ছড়া খালগুলো উদ্ধার করে বাহবা কুড়ান। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মেয়রকে ছড়া খাল উদ্ধারে সহযোগিতা করেন। আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটকে নান্দনিক সাজে সাজাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেন। যানজট নিরসনে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রিকশা লেন নির্মাণ করেন। সিসিকের নিজস্ব সিকিউরিটি নিয়োগ করে রিকশা লেন দিয়ে রিকশা যাতায়াতে বাধ্য করেন। কখনও নিজেই ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করেন মানুষ। নগরবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে আড়ালে চলে যান মেয়র। কিছুদিন পর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। জেলহাজতে চলে যাবার পর আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
পরবর্তী সময়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের পদ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এনামুল হাবিবকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ভেস্তে যায় স্বপ্নের ওয়াইফাই নগরী কিংবা কসমোপলিটন সিটি। থমকে যায় সবকিছু। নগরীতে ফিরে আসে সেই পুরনো জলাবদ্ধতা, যানজট আর ছড়া খালগুলো ভরে ফিরে গেছে পূর্বের অবস্থায়। নগরীর পথে পথে এখন অভিভাবকহীনতার চিত্র। থমকে গেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
নগরবাসীর এমন অভিযোগকে সমর্থন জানিয়ে সিসিকের বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বলছেন, সিটি করপোরেশন এখন পুরোপুরি অভিভাবকহীন। কোনো কিছুতেই সমন্বয় নেই।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান এই প্রতিবেদককে বলেন, সিটি করপোরেশনে এখন কোনো জনপ্রতিনিধির প্রতিনিধিত্ব নেই। যে যার মতো করে চলছেন। কোনো কাজেই সম্পৃক্ততা নেই। আমরা কোনো অভিভাবক খুঁজে পাচ্ছি না। জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। মানুষের অধিকার বুঝিয়ে দিতে পারছি না। নগরীর রাস্তাঘাটের বেহাল দশা আর অল্প বৃষ্টিতে সীমাহীন জলাবদ্ধতার কারণে আমরা দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাজেট সভা হচ্ছে না। কোনো কাজে আমাদের ডাকা হচ্ছে না। এ সবকিছুই হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকার কারণে। আরিফুল হক চৌধুরী যে উন্নয়ন কাজ শুরু করেছিলেন সরকারের হেফাজতে চলে যাওয়ার পর তা পুরোপুরিই থমকে গেছে।
তবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব এই প্রতিবেদককে বলেন, রাস্তাঘাটে ময়লা কোথায়? আমি তো দেখি না। প্রতিদিন রাতে পরিচ্ছন্নকর্মীরা ময়লা পরিষ্কার করে। জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে রিকশা লেন তুলে দিতে। আমরা তুলে দিয়েছি। হকারদের ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করতেই শিগগিরই অভিযান চলবে। মূল প্রতিবেদনঃ ঢাকা টাইমস ২৪