ব্লগ লেখা মানেই কী ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান?
মুহাম্মদ আবদুল কাহহারঃ ব্লগ কথাটি এখন আর নতুন নয়। যিনি ব্লগ লেখেন তাকে ব্লগার বলে। ব্লগ লিখতে পারা একটি গুণ। তবে কি লিখতে হবে সে বিষয়ে সঠিক কোন নির্দেশনা না থাকায় যে যার মতো লিখে যাচ্ছে। এতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যে বিষয়ে ব্লগারের জানা-শোনা ও অভিজ্ঞতা বেশি সে বিষয় ব্লগ লিখতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ব্লগার যে বিষয়ে ভাল জানেন না বা অপেক্ষাকৃত কম জানেন, সেই বিষয়ে নিজের মতো করে বিবেক প্রসূত অসাড় চিন্তা নিয়ে অন্যকে জ্ঞান দিতে কাল্পনিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরণের অপব্যাখ্যা ও কাল্পনিক লেখনি দ্বারা সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
ব্লগ লেখার পেছনে সবার উদ্দেশ্যও মহৎ নয়। কেউ ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌছে দিতে ব্লগ লেখেন। কেউ আবার ব্লগ লেখেন ব্যক্তিগত বিষয়ে শুধুই পাঠকের মন জয় করতে। কেউ লেখেন নিজেকে প্রকাশ করতে। কেউবা অর্থাপার্জন করতে কেউ বাতিল মতবাদকে প্রকাশ করতে বা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। এছাড়া বিষয়সহ রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, প্রেম-প্রীতি বা ভালবাসা ইত্যাদি বিষয়ে ব্লগ লেখা হয়। তবে গত ৯ আগস্ট’১৫ পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ব্লগারদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না, লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না। গত ০৭ আগস্ট পিরোজপুরের নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল ) রাজধানীর গোড়ানের ভাড়া বাসায় খুন হন। এর আগে চলতি বছরের ১২ মে সিলেট নগরের সুবিদ বাজারে রাস্তার ওপর ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিজিৎ রায় এবং ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণের সক্রীয় কর্মী রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা) কে হত্যা করা হয়েছিল। এ নিয়ে চলতি বছরে চারজন ব্লগারসহ মোট ৫ জন কে হত্যা করা হলো। এসব ঘটনায় অপরাধীদের সনাক্ত করা যায়নি বলে খবরে প্রকাশ। শুক্রবারের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী অজ্ঞাতনামা ৪ জনকে আসামী করে মামলা করলেও এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করার কোন ক্লু পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছে পুলিশ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পমন্ত্রী ও আইন শৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রীপরিষদ কমিটির সভাপতি আরি হোসেন আমু বলেছেন, সম্প্রতিক সময়ে ব্লগার ও শিশু হত্যাকান্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, প্রেট্রোলবোমা ও নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল তারাই এসব হত্যাকা-ের নেপথ্যে ইন্ধন যোগাচ্ছে। কার কথা বিশ্বাস করবো পুলিশ নাকি মন্ত্রির ? যে কেউ ব্লগ লিখবেন এটা তার নাগরিক অধিকার। কিন্তু ইসলামকে খাটো করতে বা মুলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন বিষয়কে নিয়ে কেন ব্লগ লেখা হয় সেটা অনেকেরই প্রশ্ন।
ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় বা নীলাদ্রী চ্যাটার্জি লেখালেখি করতেন ‘নীল নিলয়’ ছদ্মনামে। তিনি ইস্টেশন ব্লগসহ কয়েকটি ব্লগ ও ফেসবুকে লিখতেন। বিভিন্ন সময়ে যে বিষয় লিখেছেন তার কিছু চিত্র তুলে ধরছি “আল্লাহর ঘর সংক্রান্ত কিছু জিজ্ঞাসা” (০৩.০৮.’১৫) শিরোনামে লিখেছেন, ‘মসজিদ নাকি আল্লাহর ঘর, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত সামাজ আদায় করে সাধারণ মানুষ। মসজিদ কোন আরাম আয়েশের বা এলাকার গৌরবের স্থাপনা নয়। মসজিদ প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মিত হবে এটা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হল মসজিদকে আলিশান হতে হবে কেন? তাকে সুসজ্জিত হতে হবে কেন? আমাদের মসজিদ সমূহকে এখন এয়ার কন্ডিশন করা হচ্ছে’। “মৌলবাদের থাবায় বন্ধ হলো রোদেলা প্রকাশনী” (১৬.০২.’১৫) এ কথাটি শুনে মনে হচ্ছে অকারণে প্রকাশনী বন্ধের দাবী উঠেছে। ঘটনার শুরু যেভাবে, পার্সিয়ান লেখক কুখ্যাত ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক আলী দস্তি রচিত টুয়েন্টি থ্রি ইয়ারস’ নামক বইয়ের স্টাডি অফ দ্যা প্রফেটিক ক্যারিয়ার অফ মুহাম্মদ শিরোনামে লেখা বইটির বাংলা অনুবাদ ‘নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর’ শীর্ষক বইটি প্রকাশ করেছে রোদেলা প্রকাশনী । তাতে তুলে ধরা হয়েছে, কুরআনকে বলা হয়েছে বানানো ও উদ্ভট এবং পবিত্র মিরাজ কে বলা হয়েছে নবীজীর কল্পকাহিনী। সর্বোপরি উম্মাহাতুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.) কে ব্যভিচারিণী আখ্যায়িত করে তার পবিত্র জীবন সম্পর্কে অসত্য, বিভ্রান্তকর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মিথ্যাচার করা হয়েছে। এভাবে মন্তব্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ রকম একটি বিতর্কীত বই অমর একুশে গ্রন্থ মেলা-২০১৫ এ রোদেলা প্রকাশনি বইটি প্রকাশ করায় সর্বত্র ওই বইটি বাজেয়াপ্ত করার দাবি উঠেছে। অথচ ব্লগার নিলয় এটাকে তুচ্ছ মনে করে মৌলবাদীদের থাবা বলে অপ্রপ্রচার করেছেন।
“এবার আসছে হালাল হুইস্কি”(৩০.১০.’১৪) শিরোনামে লিখেছেন,‘ মুমিনরা কেন যেন একটু হালাল বেশীই খুঁজে। ১০০% হালাল সাবান। সবকিছুরই হালাল ভার্শন বের হচ্ছে। গুগলে যেয়ে মুমিনরা আজকাল হারাম পণ্যের বদলে হালাল পণ্য দেখে, কারণ ওগুলো দেখলে কোন গোনাহ হয়না’। “ সুদ কি আসলেই হারাম” সুদ কখনই আমার কাছে খারাপ কিছু মনে হয় না। সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করে লিখেছেন, “অবশেষে যৌনদাসী সাপ্লাইয়ের টেন্ডার পেলো বাংলাদেশ”! (১৩.০২.’১৫)। নারী ও পুরুষদের বিষয়ে শিরোনাম করেছে, “ছাগল নারী ও কুকুর পুরুষের অকথ্য কথন”(১৯.১২.’১৪)। এছাড়া ‘হরেক রকম সরস্বতী’; ‘বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র: নারীরা হলো উন্মুক্ত মলের মতো দুর্গন্ধযুক্ত’’। অনলাইনে নারীপুরুষের চ্যাঁট হারাম(০৪.০৯.’১৪) “রোকেয়ার হালাল নারীবাদ” (১০.১২.’১৩)। সিগারেট খাওয়া নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিমত শিরোনোমে ধুমপানরত একটি পুরুষ ও একটি নারীর ছবি দেখিয়ে পুুরুষের ছবির নিচে লিখেছেন হালাল আর নারীর ছবির নিচে লিখেছেন হারাম। “সর্বরোগের মহাওৗষধি গোমাতার পবিত্রমূত্র” (০২.০৫.’১৪)। “আল্লাহ বাঁচালে হজে যাবো” (১৪.০৯.’১৪) বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের একটি কাল্পনিক সক্ষাৎকার তুলে ধরে বলেছেন, কমরেড না আলহাজ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, কমরেডের চেয়ে বাংলাদেশ আলহাজের মূল্যায়ন বেশী। কোরআনে ইহুদি, নাসারা, কাফের, বেধর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক কথা রয়েছে তবে বামধারার বিরুদ্ধে একটি কথাও নেই। এ কথা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছে বামদেরকে নাস্তিক বলা অনুচিত। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বামদের বিষয়ে কিছু বলেননি। এভাবেই নিজের কাল্পনিক চিন্তার বর্হিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
নিলয় হত্যাকে কেন্দ্র করে যে বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। “তিন মাস আগেই ব্লগার নিলয় হত্যার খবর ভারতীয় পত্রিকায়! ” আরটিএনএন সূত্রে আমার দেশ অনলাইন ডটকম (০৮.০৮.’১৫) শিরোনাম করেছে। সংবাদে বলা হয়েছে, “ডেইলি ও” নামের ভারতীয় অনলাইন পত্রিকাটিতে গত ১৪ মে’১৫ প্রকাশিত নিবন্ধটির শিরোনাম হচ্ছে-‘ঘরষড়ু, আরলরঃ, অহধহঃধ. ওং ইধহমষধফবংয নবপড়সরহম চধশরংঃধহ?’ নিবন্ধটির লেখক কললেশ সিং। শিরোনামের শুরুতে নিলয়ের নাম থাকলেও পুরো প্রবন্ধের মধ্যে কোথাও নিলয়ের নাম আসেনি। অভিজিৎ, অনন্তের নামের সাথে নিলয় নামটি তিন মাস আগে কীভাবে যুক্ত করে ভারতীয় পত্রিকা শিরোনাম করলো সেই প্রশ্নটির উত্তর অজানা থেকে গেল।
যদিও নিলয় নীলকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়দা ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা আনসার আল-ইসলাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংগঠনটির মুখপাত্র মুফতি আবদুল্লাহ আশরাফের পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় এ দায় স্বীকার করা হয়। এই বার্তা প্রেরক ও হত্যাকারীরা আদৌ একই সংগঠনের কি না তা নিশ্চিত নন পুলিশের কর্মকর্তারা। যে কারণে এর সত্যতা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। এর আগে যে কয়টি হত্যা কান্ড ঘটেছিল তখনও এ রকম বার্তা পাঠানো হয়েছিল। তাই প্রকৃত অপরাধীদেরকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত অন্যকে দায়ী করা নিঃসন্দেহে এক ধরণের যুলুম। এ হত্যা কান্ডের সাথে কে বা কারা জড়িত তা জানা না গেলেও আশামনির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে পত্রিকায় সংবাদ এসেছে।
যাইহোক, কতিপয় ব্লগার ইচ্ছা করেই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন। ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব বাতিল শক্তি আছে তারা আর্থিক সহযোগীতার মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের মতো গণজাগরণমঞ্চকে পরিচালনা করে থাকে। থাবা বাবা ও নিলয়ের মতো ব্লগারকে অপশক্তিকে টাকা দিয়ে সাহায্য করার কারণেই হয়তো তারা ইসলামের নামে বিষোধগার করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, তসলিমা পক্ষ নামে বাংলাদেশে যে সংগঠনটি বাংলাদেশে আছে নিহত নীলাদ্রী ও তার কথিত স্ত্রী এবং তাদের বন্ধু সাজু সেই সংগঠনের উদ্যোক্তা। নিলয় নিল তার লেখার মধ্যে নিজেকে খুব জ্ঞানী ও সৎ মনে করলেও তার গোটা জীবনই ছিল ভুলে ভরা। কেননা, নীলয় নিল আশামনি নামে তার এক স্ত্রীর কথা ও ছবি গণমাধ্যমে ছাপা হলেও তার পরিবার ও পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধানে ভিন্নমত রয়েছে। তার বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায়, মা অর্পণা চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের সাথে দাবি করলেন নিলয় বিয়ে করেনি। আর তার খালা সাথী চট্টোপাধ্যায় ও একমাত্র বোন দাবি করেন নিলয় বিয়ে করেছে এই খবর আমরা জানিনা। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, আশামনি তার স্ত্রী নয়, আশামনির সাথে লিভ টুগেদার করতেন বলে পরিবারেরর সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। তারা মূলত বন্ধু, একসঙ্গে থাকতেন। এমন চরিত্রের লোকদেরকে গণজাগরণের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার নিজেদের কর্মী বলে দাবী করে নির্দিষ্ট কিছু মিডিয়াতে সাফাই গাইছেন। ব্যাপারটা তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
কেউ কেউ এদেরকে বুদ্ধিজীবি বলেও মনে করেন। তাদেও বলতে চাই, এরা যদি হয় বুদ্ধিজীবি তাহলে বুদ্ধিভ্রষ্ট-পথভ্রষ্ট কারা? একাত্তুরের বুদ্ধিজীবিদের সাথে নিলাদ্রী ও থাবা বাবাদেও তুলনা করলে শহীদ বুদ্ধজীবিদের অসম্মান করা হয়। এ ধরণের ব্লগারগণ মুসলিমদের গালি দিতে পারলেই নিজেদেরকে বুদ্ধিমান ভাবে। তাদের দৃষ্টিতে অন্যরা ভন্ড, ধর্মান্ধ, বুদ্ধিহীন। তবে এটা সত্য যে, নিলয়ের হত্যাকারী যেই হোক তার বা তাদের উপযুক্ত বিচার হতে হবে। কেননা, এভাবে কাউকে হত্যা করা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]