সিলেটে যমুনা ব্যাংকের দুই ব্যবস্থাপক কতৃক সাড়ে ৪কোটি আত্মসাৎ
শাহ মো. হেলাল, বালাগঞ্জঃ সিলেটের ওসমানীনগরে যমুনা ব্যাংক গোয়ালাবাজার শাখা ও সিলেট মধুবন শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদুল আলম তুহি ও মো. মোজাম্মেল হক গোয়ালাবাজার শাখার ৯ গ্রাহকদের প্রায় সাড়ে ৪কোটি টাকা আÍসাত করেছে বলে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা অভিযোগ করেছে । গত ১৭ জুন যমুনা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের লিখিত আদেশের মাধ্যমে গোয়ালাবাজার শাখা ব্যবস্থাপক জাহিদুল আলম তুহি ও সিলেট মধুবন শাখার ব্যবস্থাপক মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যমুনা ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের অভ্যন্তরীন নিয়ন্ত্রণ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত নিরীক্ষায় গোয়ালাবাজার শাখার গ্রাহক হায়দর আলীর এফডিআরের ৭৫ লাখ টাকা গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদুল আলম তুহি আÍসাত করেন বলে প্রমানিত হয়। এর প্রেক্ষিতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে জাহিদুল আলম তুহিকে আসামী করে গোয়ালাবাজার শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক তপন ভট্রাচার্য্য বাদী হয়ে গত ৪ জুলাই ওসমানীনগর থানায় একটি মামলা (নং-০৩) দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের জন্য থানা পুলিশ ৫ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন সিলেটের উপ-পরিচালকের কাছে প্রেরণ করেছে। গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন অভিযুক্ত দুই ব্যবস্থাপক তাদের টাকা পরিশোধ না করে পালিয়ে রয়েছেন। যমুনা ব্যাংকের দুই ব্যবস্থাপক কর্তৃক গ্রাহকদের টাকা আÍসাতের ঘটনায় ব্যাংকের স্থানীয় শাখা প্রধান কার্যালয় ওসমানীনগরের ব্যাংক পাড়ায় ও গ্রাহকসহ গোটা উপজেলা জুরে তুলপাড় চলছে। ইতিমধ্যে যমুনা ব্যাংক গোয়ালাবাজার শাখার অনেক গ্রাহকরাই ভয়ে তাদের টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। কিছু কিছু গ্রাহকে স্থানীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বুঝিয়ে শুনিয়ে টাকা রেখেছে।
এদিকে গ্রাহকদের টাকা ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা আÍসাতের অভিযোগ শুনে গত ১০ জুন যমুনা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ডিএমডি হাবিবুর রহমান গোয়ালাবাজার শাখা পরিদর্শনে আসেন এবং তার সাথে সিলেট মধুবন ও গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক এবং জাহিদুল আলমকে উপস্থিত করান। ডিএমডি পাওনাদার ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকদেরকে ব্যাংকে ডাকেন। হাবিবুর রহমান এ সময় গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের ব্যাপারে তিনি দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন বলে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা সবুজ সিলেটকে জানান। ৯জুন গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদুল আলম ব্যাংকেই পাওনাদার গ্রাহক যার যার নিকট থেকে যত টাকা করে নিয়েছে সে টাকার অংক উল্লেখ করে টাকা পরিশোধের তারিখসহ প্রত্যেক গ্রাহককে একটি করে অঙ্গিকারনামা প্রদান করেন। জাহিদুল গ্রাহকদের অঙ্গিকারনামায় গত ১৫ ও ৩০ জুনের মধ্যে সকলের পাওনা টাকা পরিশোধ করার কথা উল্লেখ করলেও উল্লেখিত তারিখের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করে তিনি পলাতক রয়েছেন বলে গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার পাওন গ্রামের নূরুল আলমের পুত্র মোজাম্মেল হক ২০১০ সালের ৫ জুলাই যমুনা ব্যাংক গোয়ালাবাজার শাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। মোজাম্মেল হক গোয়ালাবাজার শাখায় যোগদানের পর এই শাখার একজন বড় গ্রাহক হিসেবে হায়দর আলীর সাথে তার পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। এর সুবাধে মোজাম্মেল হায়দর আলীর বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা সাড়ে তিন কোটি টাকা তুলিয়ে এনে তার যমুনা ব্যাংক গোয়াবাজার শাখায় এফডিআর হিসেবে জমা রাখেন।
মোজাম্মেল ব্যাংকের প্রয়োজন বলে হায়দার আলীর নিকট থেকে ৭টি এফডিআরের মাধ্যমে ব্যাংকের প্রয়োজনে ১কোটি ৯৩ লক্ষ ও নগদ ৭৫ লক্ষ টাকাসহ মোট ২কোটি ৬৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। পরবর্তীতে মোজাম্মেল গোয়ালাবাজার শাখা থেকে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারী যমুনা ব্যাংক সিলেট মধুবন শাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে বদলি হয়ে যান। চলতি বছর জুন মাসের ১৭ তারিখ ৩শ’ টাকার স্ট্যাম্পে মোজাম্মেল হক হায়দার আলীকে লিখিত অঙ্গিকার প্রদান করে ২৫ জুনের মধ্যে তার সমুদয় পাওনা টাকা ফেরত দিয়ে দিবেন বলে জানান হায়দর আলী। গোয়ালাবাজার শাখার আরেক গ্রাহক আলা উদ্দিন রিপনের নিকট থেকে ১৫ লক্ষ টাকা নেন মোজাম্মেল। মোজাম্মেল রিপন ও হায়দারের টাকা পরিশোধ না করে বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারী যমুনা ব্যাংক গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক সিলেট শিবগঞ্জ ১১ মৌচাকের মৃত আবুল লেইছের পুত্র জাহিদুল আলম তুহি। জাহিদুল দীর্ঘ দিন থেকে এ শাখায় কর্মরত থাকায় ব্যাংকের বড় বড় গ্রাহকদের সাথে তার জানা শুনা ও সখ্যতা গড়ে উঠে। এর সুবাধে সিলেট মধুবন শাখার ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হকের যোগসাজসে গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদুল ব্যাংকের বড় বড় কয়েকজন গ্রাহকের নিকট থেকে ব্যাংকের প্রয়োজনের কথা বলে অপি থাই এলমোনিয়ামের সত্তাধীকারী হরেন্দ্র সূত্রধর ও তার ছেলে নিন্টু সূত্রধরের নিকট থেকে কয়েক ধাপে ৭১ লাখ টাকা, ঝলক গ্লাস এন্ড ফোম সেন্টারের সত্তাধীকারী নীরেন্দ্র কুমার পাল মিন্টুর নিকট থেকে ২০ লক্ষ টাকা, মুরাদ এন্টার প্রাইজের শাহজাহানের নিকট থেকে ৭ লক্ষ ৪৪ হাজার, বাপ্পি এন্ড ব্রাদার্সের অনিল দেব নাথের নিকট থেকে ৭ লক্ষ ১০ হাজার, কুশিয়ারা ট্রেডিং এর আতাউর রহমানের নিকট থেকে সাড়ে ৬ লক্ষ, শাহিন মিয়ার নিকট থেকে ২৮ লক্ষ ও আব্দুল মিয়ার নিকট থেকে ৩ লক্ষ টাকা ধার নেয়। জাহিদুল ধার নেয়া প্রত্যেক গ্রাহককে তার একাউন্টের চেক প্রদান করেছে বলে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানিয়েনে। জাহিদুলকে টাকা ধার দেয়ার জন্য সিলেট শাখার ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক ফোনে সকল গ্রাহকদেরকে অনুরোধ করেন এবং যথা সময়ে তা পরিশোধ করা হবে বলে গ্রাহকদের আশ্বাস দিয়েছেন বলে ক্ষতিগ্রস্থরা জানিয়েছেন। দুই ব্যবস্থাপকের অনুরোধেই গ্রাহকরা তাদেরকে টাকা প্রদান করে।
এদিকে ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট ৩শ টাকার জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গোয়ালাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদুল উল্লেখ করেন মধুবন শাখার ব্যবস্থাপকের পরামর্শে তাকে নিয়েই তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আÍসাত করেন।
ঝলক গ্লাস এন্ড ফোম সেন্টারের সত্তাধীকারী নীরেন্দ্র কুমার পাল মিন্টুর ছেলে বিষ্ণু পাল বলেন, আমাদের সিসি একাউন্টের একটি চেক ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী দিতে হবে বলে ম্যানেজার জাহিদুল আলম বলেন। আমরা চেক দিতে অপারগতা জানালে সিলেট শাখার ম্যানেজার মোজাম্মেল ফোন করে বলেন ব্যাংকের আইন সাদা চেক দিতে হবে। বাধ্য হয়ে তাদেরকে চেক প্রদান করি। কয়েক দিন পর খোঁজ নিয়ে দেখি আমাদের সিসি লোনের হিসাব নং থেকে বিশ লক্ষ টাকা তারা তুলে নিয়ে গেছে। মোজাম্মেল হক আমাকে তার ব্যক্তিগত হিসাব নং-০০৮০৩১৫০০০৬৭৬ থেকে সিসির ২০ লক্ষ টাকার সুদসহ ২১ লক্ষ টাকার ১৭/০৬/১৫ তারিখের একটি চেক প্রদান করেন। কিন্তু তার হিসাব নাম্বারে কোন টাকা নেই। এই চেক দিয়ে টাকা তুলতে পারিনি।
ক্ষতিগ্রস্থ শাহিনের ভাই সেলিম বলেন, আমার ভাই ম্যানেজার জাহিদুলের নিকট আমাদের হিসাব নং এ ২৮ লাখ টাকা জমা দিতে দেয়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় আমাদের হিসাব নম্বারে টাকা জমা হয়নি। জাহিদুল আমাদেরকে একটি ভূয়া জমা স্লিপ ও ষ্টেইটমেন্ট দিয়েছেন টাকা জমা দেয়া হয়েছে বলে। ম্যানাজার কর্তৃক টাকা আÍসাতের কারণে আমার ছোট ভাই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি।
ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহক শাহজাহান, রিপন, আব্দুল, অনিল ও হরেন্দ্র বলেন, ব্যাংকের সব কিছুর দায় দায়িত্ব শাখা ব্যবস্থাপকের। তাকেই চিনে আমরা একাউন্ট ও লেনদেন করেছি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আমাদের টাকা মেরেছে। এখন আমরা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের টাকা ফেরত চাই। টাকা না পেলে আমরা ব্যাংকের ওপর মামলা করবো।
বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের জেনারেল ম্যানেজার মোবারক হোসেন সবুজ সিলেটকে বলেন, গ্রাহক স্বার্থ দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল দায়িত্ব। কোন গ্রাহক অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
যমুনা ব্যাংকের এমডি শফিকুল আলম সবুজ সিলেটকে বলেন, আমরা তদন্তের মাধ্যমে দোষিদের সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দিছি। চোরদের পুলিশে দেয়া হবে। যে গ্রাহকরা ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে বৈধ রশিদ দেখাতে পারবে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। যারা ব্যক্তিগতভাবে ম্যানেজারের সাথে লেনদেন করেছেন তাদের দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না।