নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে হাইকোর্টের দুই বিকল্প ফর্মুলা

  • ফর্মুলা-১: প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সকল দলের সমন্বয়ে ৫০ সদস্যের মন্ত্রিসভা।
  • ফর্মুলা-২: সংসদের ৫ বছর মেয়াদের শেষ বছরে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে সরকার। মেয়াদ শেষে ফর্মুলা-১ এর আওতায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা।

hight courtসুরমা টাইমস ডেস্কঃ সুপ্রীম কোর্টের রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হবার পর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকট, সংঘাত ও অচলাবস্থা চলছে। এ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ২০১৩-১৪ এবং ২০১৫ সালে মাসের পর মাস হরাতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় মানুষের ব্যাপক প্রানহানি ও সম্পদহানি হয়েছে। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে দিনের পর হাসপাতালের বেডে যন্ত্রনায় কাতরিয়েছে বহু মানুষ। নিভে গেছে বহু সম্ভাবনাময় জীবন প্রদীপ।
এ অবস্থায় সংঘাতমুক্ত পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য ব্যবস্থায় হাইকোর্ট পরবর্তী দু’টি (একাদশ ও দ্বাদশ) সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। এ জন্য হাইকোর্ট দু’টি বিকল্প ফর্মুলাও দিয়েছে।
প্রথম ফর্মুলায় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংসদের সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ৫০ সদস্যের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় ফর্মুলায় ক্ষমতা-ভাগাভাগির কথা বলা হয়েছে। এতে সংসদের ৫ বছর মেয়াদের শেষ বছরে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও নিবাচনকালীন সরকার ফর্মুলা-১ অনযায়ী গঠিত হবে।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিয়ে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে দেয়া রায়ে হাইকোর্ট এ ফর্মুলা দিয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে হাইকোর্টের এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত ঐ একতরফা নির্বাচন বর্জন করে।
২০১১ সালে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট ওই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ২০১৩ সালের শেষ দিকে ও ২০১৪ সালের শুরুতে দেশব্যাপী তীব্র সহিংস আন্দোলনে নামে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি জোটের বর্জন সত্ত্বেও ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী করে অনেকটাই ভোটারবিহীন ওই নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।
জাতীয় পার্টির নেতা খন্দকার আব্দুস সালাম ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল অথবা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকারের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন।
বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের দ্বৈত বেঞ্চ শুনানি শেষে গত বছর ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় নির্বাচনকে বৈধ বলে রায় দেন। তবে লিখিত রায়ের পর দেখা গেল, দুই বিচারক নির্বাচনকালীন সরকারের বিকল্প দুটি ফর্মুলাও দিয়েছেন।
ফর্মুলা-১
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, অনুযায়ী প্রথম ফর্মুলা অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এমন সব দলের এমপিরা আনুপাতিক হারে এ সরকারের মন্ত্রী হবেন। দশম সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে মন্ত্রিত্বের সংখ্যা নির্ধারিত হবে। গত সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিত্বের জন্য ৫ জন মন্ত্রী ঐ দু’টি দল থেকে নেয়ার কথাও ফর্মুলায় বলা হয়েছে। সংবিধানে সংসদ সদস্য নন, তবে সদস্য হবার যোগ্য এমন ব্যক্তিদের থেকে ১০ শতাংশ মন্ত্রী নেয়ার বিধান রয়েছে। এরই আলোকে ৫০ সদসের মন্ত্রিসভায় সংসদ সদস্য নন এমন ৫ জন (টেকনোক্র্যাট) মন্ত্রী নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বিএনপি জোটের ঐ পদে তাদের প্রতিনিধি মনোনয়ন দেবার সুযোগ রয়েছে।
নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ে অথবা আগে ভেঙে যাওয়া সংসদের ক্ষেত্রে ভাঙার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। ফর্মুলায় নির্বাচনের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলোকে বন্টনের বিষয়েও সূত্র দেয়া হয়েছে। বিতর্ক এড়ানোর জন্য লটারির মাধ্যমে এ মন্ত্রণালয়গুলো বন্টনের কথা বলা হয়েছে। একাদশ ছাড়াও দ্বাদশ নির্বাচনও এ ফর্মুলায় হতে পারে বলে হাইকোর্টের রায়ে মত দেয়া হয়েছে।
এ ফর্মুলাটি আওয়ামী লীগ সরকারের তাদের সংশোধিত সংবিধানের বাইরে না যাওয়া এবং অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নিজের অধীনে এ ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকে তার পছন্দের মন্ত্রণালয়ও দিতে চেয়েছিলেন। সংশোধন ছাড়াই বর্তমান সংবিধানের আওতায় এ ফর্মুলায় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে এর অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
ফর্মুলা-২
নির্বাচনকালীন সরকারের দ্বিতীয় ফর্মুলায় হাইকোর্টের রায়ে সরকারি দল ও সংসদে প্রধান বিরোধীদলের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা বলা হয়েছে। এ ফর্মুলা অনুযায়ী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংসদের ৫ বছর মেয়াদের প্রথম ৪ বছর সরকারে থাকবে। এরপর প্রধান বিরোধী দল পরবর্তী এক বছরের জন্য সরকার গঠন করবে। তবে প্রধানবিরোধী দলের ক্ষমতাপ্রাপ্তির শর্ত হচ্ছে, তাকে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্তভোটের অর্ধেক ভোট পেতে হবে। ১ বছরে মেয়াদ শেষে প্রথম ফর্মুলা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা তথা পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংসদের সকল দল থেকে আনুপাতিক হারে ৫০ জন মন্ত্রী নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। এ সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম ফর্মুলার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না। তবে বর্তমান সংবিধানের আওতায় এ ধরনের সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয় ফর্মুলায় বর্ণিত ক্ষমতা ভাগাভাগি করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু ওই ফর্মুলার শেষাংশ-অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না।
হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচনকালীন সরকারের ২টি ফর্মুলার সাথে নির্বাচনের সময় যে কোন মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আদেশও গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে বাতিল করে দেবার ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ৫ বছর অথবা মেয়াদ পূর্তির পর অবাধ, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন আয়োজন রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের আলোকে নির্বাচন কমিশন যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারে তাই নির্বাচনের আগে এবং পরে নির্বাচন-বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা দেশের সব রাজনৈতিক দলের নৈতিক দায়িত্ব। এ কারণে সকল রাজনৈতিক দলকে রাজপথে বিক্ষোভ অথবা সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
রায়ে বলা হয়, এ ফর্মুলা সংঘাতমত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সুযোগ করে দিতে পারে। সকল সরকারি বিভাগ ও সংস্থাসহ সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের যথাযথ কর্ম-পরিবেশে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অন্যথায় নির্বাচনকালনি সরকারের বিষয়ে সংবিধানে যত উত্তম ফর্মুলাই সংযোজন করা হোক না কেন, তা আমাদের দেশে কাজ করবে না। কারণ স্বার্থান্বেষী মহল একে বিতর্কিত ও অকার্যকর করে দেবে, যা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে হয়েছে।
এ ফর্মুলা প্রদানের বিষয়ে হাইকোর্টের ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিচারকরা এ দেশের নাগরিক হিসেবে এ সাংবিধানিক ইস্যুতে জনগণের জীবন ও জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেন না। রায়ে বলা হয় : ‘আমরা এই কোর্টের বিচারকদ্বয়, আমরা সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়েছি, যে পবিত্র দলিল আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি’।