নগরীতে দশ হাজারেরও বেশী নিষিদ্ধ যানবাহন

illegal auto at sylhetইয়াহইয়া মারুফঃ যোগাযোগ মন্ত্রীর পর অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে টনক নড়লেও নিষিদ্ধ যানবাহন ব্যাটারি চালিত টমটম-অটোরিকশার বিরুদ্ধে সিলেটের সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও এসএমপি পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযান স্থায়ী হয়নি। ডাক-ঢোল পিটিয়ে ৩ থেকে ৪ দিনের লোক দেখানো অভিযানে ২৮ টি ব্যাটারি পুড়িয়ে ও কয়েকটি রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়েছে তাদের। ‘ডাক-ঢোল পিটিয়ে যৌথ অভিযান যেন ২ মন্ত্রীর নির্দেশ পালন আর দায় মুক্ত হওয়ার অভিযান ছিল।’ এরপর এসব যানবাহন উচ্ছেদে সিলেট প্রশাসনের আর কোন অভিযান বা পরিকল্পনা দেখা যায়নি। এদিকে, নগরীতে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই দাপটের সাথে চলাচল করছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশী ব্যাটারি চালিত টমটম-অটোরিকশা। ফলে, প্রতিনিয়ত ঘটছে র্দুঘটনা, রাস্তা-ঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যানজটে পরে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়ও। এ সব নিষিদ্ধ যানবাহনের ব্যাটারি র্চাজে গ্রহণ করছে প্রতিদিন ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ। সরকার হারাচ্ছে প্রতিমাসে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার রাজস্ব আয়। বিদ্যুৎ লোড শেডিং, র্দুঘটনা আর যানজটে চরম ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন নগরবাসী। অপরদিকে, নগর পুলিশ প্রশাসনরে ট্রাফিক বিভাগ ব্যাটারি চালতি যানবাহন চলাচল বন্ধে অভিযান চলমান রয়েছে জানালেও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশের একসাপ্তাহের মাথায় গত ২৭ মে‘র পর থেকে এসব যানবহান চলাচল বন্ধে দৃশ্যমান অভিযান বা বিশেষ কোন উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি।
সূত্রমতে, ডাক-ঢোল পিটিয়ে সর্বশেষ লোক দেখানো এ অভিযান অর্থমন্ত্রীর নির্দেশের প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ২৭ মে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধা পর্যন্ত পরিচালনা করে সিলেট সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও মহানগর পুলিশ। ব্যাটারিচালিত যানবাহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আদালতে রিট দাখিল থাকায় আপাতত কোনো অভিযান চলছে না বলেও জানা গেছে।
অপরদিকে, পুলিশ প্রশাসনরে ট্রাফিক বিভাগ বলছে, লোকবল সংকট থাকায় দৃশ্যমান কোন অভিযান পরিচালনা করা না গেলেও ব্যাটারি চালতি যানবাহন চলাচল বন্ধের অভিযান চলমান রয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর নির্দেশেরে পর থেকে এসব যানবহান চলাচল বন্ধে দৃশ্যমান বিশেষ কোন উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি। দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে নেই কোন বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনাও। ফলে নগরীতে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই নির্বিঘ্নে চলাচল করছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ব্যাটারি চালিত যানবাহন। প্রতিনিয়ত রাস্তা-ঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যানজটে পরে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়ও। আর বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এ সব যানবাহন প্রতিদিন ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রহন করছে। যার দরুণ বিদ্যুৎ লোড শেডিং ও যানজটে চরম ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন নগরবাসী। এ নিয়ে মাসের পর মাস নগরীতে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এসব যান নগরী থেকে তোলার জন্য আন্দোলনও হয়েছে। বারবার উদ্যোগও নেয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি কোন বারই।
প্রশ্ন ওঠেছে, যোগাযোগ মন্ত্রী নিজেই সিলেটে আভিযান চালিয়ে দেওয়া নির্দেশের বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এরমধ্যে আবার অর্থমন্ত্রীর নির্দেশও, ‘দুইমন্ত্রীর নির্দেশের বাস্তবায়ন কবে হবে?’ আর সচেতন মহল ধারণা করছেন, প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী নির্দেশের বাস্তবায়ন না হওয়ায়-মনে হচ্ছে সরকার প্রশাসনকে ধর্না দিয়েই দেশ চালাচ্ছে। দেশ পরিচালিত হচ্ছে প্রশাসনের নেতৃত্বে, সরকারের নয়।
সিলেট চেম্বার অব কর্মাস ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রশাসক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এ বিষয়ে মন্তব্য করে প্রতিবেদককে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশাসন সরকারে নিয়ন্ত্রনের বাইরে কিনা? গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি যারা করেন, তারা দেশ চালান না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশসান দেশ চালায়? এটাই এখন আসল প্রশ্ন। এছাড়া অর্থমন্ত্রী ইতিপুর্বে কয়েকটি নির্দেশের বিষয়ও সিলেটের প্রশাসন আমলে নেয়নি। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী কাছে সরকার যে তারা পরিচালনা করছেন এমন দৃষ্টান্ত সিলেটবাসীকে দেখাবেন।
জানা যায়, সম্প্রতি কয়েক মাস আগে ঝটিকা সফরে এসে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই সিলেটে ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহন জব্দ করেছিলেন। তিনি প্রশাসনকে এসব যানবাহন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর নির্দেশের বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হওয়ার আগেই যোগ হয়েছিল অর্থমন্ত্রীর নির্দেশও।
সিলেটে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এমপি সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ব্যাটারি চালিত যানবাহনের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এ ব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ গাড়ি আটক করলে সেটা ছাড়বে না। এর পক্ষে যারা কথা বলেন বা সুপারিশ করেন তাদের জেলে দেওয়া উচিত।
মন্ত্রী বলেন, ব্যাটারি চালিত যানবাহন দেশে আমদানি বন্ধ। সরকারের এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অবৈধভাবে এই গাড়ি রাস্তায় চালান, তাদের পক্ষে যারা কথা বলেন, এধরণের দুঃসাহস কোথায় পেল বলেও প্রশ্ন রেখেছিলেন প্রবীন এই মন্ত্রী। এসব অবৈধ গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করতে মন্ত্রী জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ওই দিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে উদ্যোগী হওয়ার কথাও বলেন তিনি।
গত ২১ মে বৃহস্পতিবার সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রাক-বাজেট আলোচনায় জনৈক বক্তা আটক ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহন ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করলে ক্ষুব্ধ হয়ে মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে এসব নির্দেশ দেন।
জানা যায়, সিলেটে ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহন প্রায় ১০ হাজার। এসব যানবাহনের চার্জের জন্য সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫ শতাধিক চোরাই চার্জার গ্যারেজ গড়ে ওঠেছে। এই রিকশার ব্যাটারি চার্জ খাতে প্রতিদিন ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে প্রতিমাসে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার রাজস্ব আয়। সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ও অটোরিকশা মালিক সুত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে সিলেটের চার্জার গ্যারেজের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ট্যাকনিক্যাল সড়কে অন্তত দুইশত চার্জার গ্যারেজে বিদ্যুতের চোরাই লাইন রয়েছে। প্রতি রাতে এসব গ্যারেজে শত শত নিষিদ্ধ যানবাহনের ব্যাটারি চার্জ দেন চালকেরা। একেকটি যানবাহন চার্জে নেওয়া হচ্ছে ৮০ টাকা। জানা গেছে, ১১ হাজার কেভির মেইন লাইন থেকে চোরাই লাইন নামিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে এসব গ্যারেজে। একই ভাবে সিলেট নগরীর আম্বরখানা , মেন্দিবাগ, ঘাসিটুলা, দাঁড়িয়াপাড়া, দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকা সবমিলিয়ে প্রায় ৫ শতাধিক চোরাই চার্জার গ্যারেজ গড়ে ওঠেছে। প্রতি দিন ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে এসব নিষিদ্ধ যানবাহনের চার্জে।
নিষিদ্ধ এসব যানবাহন চলাচলে নগরীতে যানজট বাড়ছে। বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে একটি চোরাই বিদ্যুৎ সংযোককারী চক্র। ট্রাফিক ও বিদ্যুতের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দিন দিন সিলেটে বেড়েই চলেছে এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জাল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিদ্যুৎ কর্মকর্তা জানান, একটি অটোরিকশায় ৩ টি ব্যাটারি থাকে। তিন ফেজের লাইনে চার্জ দেওয়ার সময় লাইনে লোড বেড়ে যাওয়ার ফলে ট্রান্সফরমারগুলো ঘনঘন পুড়ছে।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ব্যাটারি চালিত কোন যানবাহন অনুমোদন তারা দেননি। প্রথম অবস্থায় ২২০টি ইজিবাইক বা টমটমের অনুমোদন দিয়েছেন। তবে নগরী ঘুরে দেখা গেছে, আম্বরখানা থেকে লাক্কাতুরা, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, কাজিরবাজার, কদমতলী, স্টেশন রোড, ভার্থখলা, বঙ্গবীর রোড, গোটাটিকর, প্রভৃতি এলাকা দিয়ে অবাধে চলছে ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহন। তাছাড়া ব্যাটারি চালিত যানবাহন তো নগরীতে দাপটের সাথে চলাচল করছে।
মন্ত্রী দ্বয়ের নির্দেশের আগে যেমন নগর জোরে ছিল ব্যাটারিচালিত নিষিদ্ধ যানবাহনের মহড়া, এখনো তা সমান তালে চলছে। মন্ত্রী দ্বয়ের এই নির্দেশের পেরিয়ে মাসের পর মাস গেলেও পুলিশ প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার দৃশ্যমান অভিযান নজরে পড়েনি নগরবাসীর। ট্রাফিক সূত্র জানায়, বছর খানেক সিলেটে নানা দেনদরবার করে ৪ হাজার অটোরিকশা চলাচলের অনুমতি দিলেও চলছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশী।
সিসিক সূত্র আরো জানায়, সাময়িক বরখাস্তকৃত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী যানজটমুক্ত নগরী গড়তে নিষিদ্ধ অটোরিকশা চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অপরদিকে, গত বছরের ৭ নভেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী সিলেটে সফরে এসে বিমানবন্দর সড়কে ও চন্ডিপুলে ১০ টি অটোরিকশা আটক করে এগুলো নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি, নগরীতে প্রকাশ্যে চলছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত যানবাহন। এরপর অর্থমন্ত্রী নির্দেশ যোগ হলেও টনক নড়েনি স্থানীয় প্রশাসনের। সর্বশেষ ডাক-ঢোল পিঠিয়ে গত ২৭ মে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধা পর্যন্ত সিলেট সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও মহানগর পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে ২৮টি ব্যাটারি পুড়িয়ে, ৭টিকে ১০০ টাকা করে জরিমানা ও কয়েকটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েই রনেবঙ্গ অবস্থায় ঘরে ফিরে ছিল সিলেট প্রশাসন।
এদিকে সিসিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই নগরীতে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। তাছাড়া ইজিবাইক (টমটম) এর ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে নগরীতে চলার অনুমোদন থাকলেও বছর তিনেক আগে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে তা নগরীর বাইরে চলাচলের নির্দেশ দেয়া হলে তা কার্যকর হয়নি। তবে এসব ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহনের অনুমোদন ও পরিসংখ্যানের ব্যাপারে জানেনা খোদ সিলেট সিটি কর্পোরেশনও। অভিযানের ব্যাপারে সিসিকের প্রধান নির্বাহী এনামুল হাবীব প্রতিবেদককে বলেন, ঈদের বিষয়টা চিন্তা করে অভিযান একটু শীতিল ছিল। অতীতে যে অভিযান হয়েছিল সেগুলোও সিটি কর্পোরেশনের উদ্দোগ্যই হয়েছিল। আমরা পুলিশ কমিশনার, ট্রাফিক বিভাগের সহায়তা নিয়ে র্শীঘ্রই আবারো অভিযানে মাঠে নামবো।
ব্যাটারি চালিত নিষিদ্ধ যানবাহন জব্দের ক্ষেত্রে পরপর প্রভাবশালী দুইমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নিকুলিন চাকমা এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করে প্রতিবেদককে বলেন, লোকবল সংকট ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্থ থাকায় দ্রুত হচ্ছে না। যেখানেই চোখে পড়ছে সেখানেই ধরা হচ্ছে।