এক কিশোর সাহাবীর খোদাভীতি

আখতার হোসাইন জাহেদ

jahedআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন কিশোর সাহাবী, নাম তার থা’লাবা। অনেকে আবার সা’লাবা বলে থাকেন। বয়স মাত্র ষোল বছর । রাসূল (সা.) এর বার্তাবাহক হিসেবে এখানে সেখানে ছুটোছুটি করে বেড়াতেন তিনি। একদিন তিনি মদীনার পথ ধরে চলছেন, এমন সময় একটা বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর চোখ পড়ল দরজা খুলে থাকা এক ঘরের মধ্যে। ভিতরে গোসলখানায় একজন মহিলা গোসলরত ছিলেন, এবং বাতাসে সেখানের পর্দা উড়ছিল, তাই থা’লাবার চোখ ঐ মহিলার উপর যেয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে থা’লাবা দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
কিন্তু থা’লাবার মন এক গভীর অপরাধবোধে ভরে গেল। প্রচন্ড দুঃখ তাকে আচ্ছাদন করল। তার নিজেকে অপরাধির মত লাগছিল। তিনি ভাবলেন, ‘কিভাবে আমি রাসূল (সা.) এর একজন সাহাবী হয়ে এতোটা অপ্রীতিকর কাজ করতে পারি?! মানুষের গোপনীয়তাকে নষ্ট করতে পারি? যেই আমি কিনা রাসূল (সা.) এর বার্তা বাহক হিসেবে কাজ করি, কেমন করে এই ভীষণ আপত্তিজনক আচরণ আমার পক্ষে সম্ভব?’ তাঁর মন আল্লাহর ভয়ে কাতর হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, ‘না জানি আল্লাহ তা’আলা আমার এমন আচরণের কথা রাসূল সা এর কাছে প্রকাশ করে দেন!’ ভয়ে, রাসূল (সা.) এর মুখোমুখি হওয়ার লজ্জায় তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান থেকে পালিয়ে গেলেন।
এভাবে অনেকদিন চলে গেল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য সাহাবীদেরকে থা’লাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই থাকতেন। কিন্তু সবাই জানাল কেউ-ই থা’লাবা কে দেখেনি। এদিকে রাসূল (সা.) এর দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছিল। তিনি উমর (রা), সালমান আল ফারিসি সহ আরো কিছু সাহাবীদেরকে পাঠালেন থা’লাবার খোঁজ নেয়ার জন্য। মদীনা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও থা’লাবার দেখা মিলল না। পরে মদীনার একেবারে সীমানাবর্তী একটা স্থানে, মক্কা ও মদীনার মধ্যখানে অবস্থিত পর্বতময় একটা জায়গায় পৌঁছে কিছু বেদুঈনের সাথে দেখা হল তাদের। দেখানে এসে তারা থা’লাবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন। ‘তোমরা কি লম্বা, তরুণ, কম বয়সী একটা ছেলেকে এদিকে আসতে দেখেছ?’ বেদুঈনরা মেষ চড়াচ্ছিল। তারা জবাব দিল, সে খবর তারা জানেনা, তবে তারা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি ক্রন্দনরত বালকের সন্ধানে এসেছ?’ একথা শুনে সাহাবীরা আগ্রহী হয়ে উঠলেন এবং তার বর্ণনা জানতে চাইলেন। উত্তরে ওরা বলল, ‘আমরা প্রতিদিন দেখি মাগরিবের সময় এখানে একটা কিশোর ছেলে আসে, সে দেখতে এতো লম্বা, কিন্তু খুব দুর্বল, সে শুধুই কাঁদতে থাকে। আমরা তাকে খাওয়ার জন্য এক বাটি দুধ দেই, সে দুধের বাটিতে চুমুক দেয়ার সময় তার চোখের পানি টপটপ করে পড়ে মিশে যায় দুধের সাথে, কিন্তু সেদিকে তার হুঁশ থাকেনা!’ তাঁরা জানালো চল্লিশ দিন যাবৎ ছেলেটা এখানে আছে। একটা পর্বতের গুহার মধ্যে সে থাকে, দিনে একবারই সে কাঁদতে কাঁদতে নেমে আসে। আবার কাঁদতে কাঁদতে আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে উপরে চলে যায়। সাহাবীরা বর্ণনা শুনে বুঝলেন, এ থা’লাবা না হয়ে আর কেহ হতে পারেনা। তাই তাঁরা উপরে না যেয়ে নিচেই থা’লাবার অপেক্ষা করতে লাগলেন।
যথাসময়ে প্রতিদিনের মত আজও থা’লাবা ক্রন্দনরত অবস্থায় নেমে আসলেন, তাঁর আর কোনদিকে খেয়াল নাই। কী দুর্বল শরীর হয়ে গেছে তাঁর! বেদুঈনদের কথামত তাঁরা দেখতে পেলেন, থা’লাবা দুধের বাটি হাতে নিয়ে কাঁদছে, আর তাঁর অশ্রু তাতে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাঁর চেহারায় যেন গভীর বিষাদের চিহ্ন । সাহাবীরা তাকে বললেন, ‘হে থা’লাবা তুমি আমাদের সাথে ফিরে চল’; কিন্তু থা’লাবা যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বারবার সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘আল্লাহ কি আমার উপর মুনাফেক্বী বিষয়ক কোন আয়াত নাযিল করেছেন? সাহাবীরা উত্তরে বললেন, ‘না আমাদের জানামতে এমন কোন আয়াত নাযিল হয় নাই।’ তখন উমর (রা.) বললেন, রাসূল (সা.) আমাদেরকে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। তুমি যদি এখন যেতে রাজি না হও, তাহলে তোমাকে আমরা জোর করে নিয়ে যাব। রাসূল (সা.) এর কথা অমান্য করবেন এমন কোন সাহাবী ছিলেননা। কিন্তু থা’লাবা এতোটাই লজ্জিত ছিলেন যে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেননা। এরপর সাহাবীরা তাকে রাসূল (সা.) এর কাছে মদীনায় নিয়ে আসলেন।
মহানবী (সা) এর কাছে এসে থা’লাবার আবারও একই প্রশ্ন, ‘আল্লাহ কি আমাকে মুনাফিক্বদের মধ্যে অন্তর্গত করেছেন অথবা এমন কোন আয়াত নাযিল করেছেন যেখানে বলা হয়েছে আমি মুনাফিক্ব?’ রাসূল (সা.) তাকে নিশ্চিত করলেন যে এমন কিছুই নাযিল হয়নি। তিনি থা’লাবার দুর্বল পরিশ্রান্ত মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখলেন। থা’লাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এমন গুনাহগার ব্যক্তির মাথা আপনার কোল থেকে সরিয়ে দিন।’ তার কাছে মনে হচ্ছিল যেন সে এসব স্নেহের যোগ্য নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সান্ত¦না দিতেই থাকলেন। আল্লাহর রহমত আর দয়ার উপর ভরসা করতে বললেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। এমন সময় থা’লাবা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমার এমন মনে হচ্ছে যেন আমার হাড় আর মাংসের মাঝখানে পিঁপড়া হেঁটে বেড়াচ্ছে।’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘এটা হল মৃত্যুর ফেরেশতা। তোমার সময় এসেছে থা’লাবা, শাহাদাহ পড়’। থা’লাবা শাহাদাহ বলতে থাকলেন, “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু”। তিনি শাহাদাহ বলতে থাকলেন,বলতেই থাকলেন এমন সময় তাঁর রুহ শরীর থেকে বের হয়ে গেল।
মহানবী (সা.) থা’লাবাকে গোসল করিয়ে জানাজার পর কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আরো অনেক সাহাবী থা’লাবাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী (সা.) পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এভাবে কেন হাঁটছেন যেন ভিড়ের মাঝে হেঁটে চলেছেন.. কতো রাস্তা ফাঁকা পড়ে আছে, আপনি আরাম করে কেন চলছেন না ইয়া রাসুলাল্লাহ?’ উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, ‘হে উমর, আমাকে অনেক সাবধানে চলতে হচ্ছে। সমস্ত রাস্তা ফেরেশতাদের দ্বারা ভরে গেছে । থা’লাবার জন্য এতো ফেরেশতা এসেছে যে, আমি ঠিকমত হাঁটার জায়গা পাচ্ছিনা’। সুবহানাল্লাহ!
এই সেই থা’লাবা যে ভুলক্রমে একটা ভুল করার জন্য এতো প্রায়শ্চিত্য করেছেন। গুনাহ-র কাজ করা তো দূরের কথা, গুনাহ না করেও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ব্যাকুল হয়েছেন। কত উঁচু ছিলেন তিনি আল্লাহর চোখে যে তাকে নেয়ার জন্য ফেরেশতাদের আগমনে রাস্তা ভরে গিয়েছিল! এই সব ফেরেশতারা নেমে এসেছে শুধু থা’লাবার জন্য, তাঁর জন্য দুআ করার জন্য, তাকে নিয়ে যাবার জন্য। আর আমরা সারাদিন জেনে না জেনে এতো ভুল করেও, এতো গুনাহ করেও অনুশোচনা করিনা,ক্ষমা চাইনা আল্লাহর দরবারে।

লেখকঃ আখতার হোসাইন জাহেদ
সংগঠক,কামিল হাদিস (এম.এ)
মোবাইলঃ ০১৭২৯৪৩৩৪৬১
ই-মেইল [email protected]