বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত
জনবল সংকটের পাশাপাশি অবকাঠামোগত সমস্যা
শাহ মো. হেলাল, বালাগঞ্জঃ নানা সমস্যায় বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ডাক্তার সংকটের পাশাপাশি অবকাঠামোগত সমস্যাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি থাকায় ৩১ শয্যা বিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিনিয়ত রোগীদের মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা তাদের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনবল কাঠামোর সকল স্তরের ১শ ৮৪টি পদের মধ্যে ৫৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া ১ম শ্রেণীর একজনসহ ৩য় শ্রেণীর ৫জন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন যাবত অননুমোদিত অনুপস্থিত রয়েছেন। শূন্য পদের মধ্যে ১ম শ্রেণীর জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী), জুনিয়র কনসালটেন্ট (হাসপাতাল) মোট ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। এবং একই শ্রেণীর ডেন্টাল সার্জন বিগত ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে অননুমোদিত অনুপস্থিত রয়েছেন। ২য় শ্রেণীর সিনিয়র স্টাফ নার্স অনুমোদিত ১০টি পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৪জন। বাকি ৬টি পদ দীর্ঘদিন যাবত শূন্য রয়েছে। ৩য় শ্রেণীর ১শ ৩৮টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৩৭টি পদ। একই শ্রেণীর স্বাস্থ্য সহকারী পদে মোট ৩৯জন কর্মরতদের মধ্যে ৫জন দীর্ঘদিন যাবত অননুমোদিত অনুপস্থিত রয়েছেন। এছাড়া ৪র্থ শ্রেণীর ১৯টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৮টি পদ। সব মিলিয়ে ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ শ্রেণীর ১শ ৮৪টি পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৫৪টি পদ। বাকী কর্মরত ১শ ৩০ জনের মধ্যে অননুমোদিত অনুপস্থিত রয়েছেন ৬জন কর্মকর্তা এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ডেন্টাল) প্রায় ১বছর যাবত প্রেষণে ঢাকায় আছেন। তবে বিশেষ করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট (আবাসিক) পদটি শূন্য থাকার কারণে সন্ধ্যা বা রাতের বেলা আগত রোগীদের চিকিৎসা সেবা মারাত্মক বিঘিœত হয়। এছাড়াও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ২টি পদই শূন্য থাকার কারণে হাসপাতালে কোন প্রকারের পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থা নেই। রোগীদের নিজ খরচে হাসপাতালের বাইরে থেকেই সকল প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী নূরুল ইসলাম ও পরিসংখ্যানবিদ ফণীভূষণ সরকার জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শূন্য পদ পূরণের ব্যাপারে উধ্বর্তন বিভাগে আবেদন জমা রয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনবল কাঠামো ছাড়াও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির প্রকট সংকট রয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একমাত্র ইসিজির ব্যবস্থা থাকলেও প্রায় ৫/৬ বছর যাবত এক্সরে মেশিন বিকল পড়ে রয়েছে। এক্সরের পাশাপাশি প্যাথলজি বিভাগের সকল প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা রোগীদের নিজ খরচে বাইরে থেকে করে নিয়ে আসতে হয়।
এতসব সমস্যার মধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবকাঠামো জটিলতাও দিনদিন প্রকট হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন রুমের দরোজা জানালা ভেঙ্গে পড়ছে। স্যানেটারী ইন্সপেক্টর একেএম সামসুদ্দিন জানিয়েছেন, তার অফিসের দরোজার একপাট প্রায় ৬মাস যাবত ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগে নির্মিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান মূল ভবনসহ অন্যান্য আবাসিক ভবনগুলোও নানা জটিলতায় ভোগছে। দু’তলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর তলার আবাসিক মহিলা ওয়ার্ডের ছাদ নষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি পড়ে। তখন রোগীদের স্থানান্তর করে নিতে হয়। একই অবস্থা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ স্টাফ নার্সদের আবাসিক ভবনেও। সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভিন জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মহিলা ওয়ার্ডসহ স্টাফ নার্স ও চিকিৎসকদের আবাসিক ভবনগুলোতেও ছাদের অংশ বিশেষ অনবরত খসে পড়ছে। এসব পুরনো ভবন ‘অনেকটা বসবাসের অনুপযোগী’ বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এদিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরবস্থার কারণে বালাগঞ্জের ১৪টি ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষ তাদের ন্যায্য চিকিৎসাসেবার সুযোগ-সুবিধা থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ চিকিৎসা গ্রহণকারীদের অভিযোগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনবল সংকটের পাশাপাশি ডাক্তার ও স্টাফদের আন্তরিকতার অভাবেও রোগীরা নানা ভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ ডাক্তাররা প্রায়ই সময়ের আগেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ত্যাগ করে চলে যান। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাহিদা মত ঔষধও পান না রোগীরা। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি কামনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গত বছরের মার্চ মাসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফমার বিকল হয়ে পড়লে প্রায় ২ মাস পর পল্লীবিদ্যুতের কাছ থেকে ভাড়ায় ট্রান্সফমার নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল করা হয়। বর্তমানে প্রায় এক বছর যাবত মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে ট্রান্সফরমার ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ মতিন বলেন, ডাক্তার স্বল্পতার পাশাপাশি কর্তব্যরত ডাক্তারদের বিষয়ে সাধারণ রোগীদের নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আসবাবপত্র সংকট ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাবে গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালিন চিকিৎসা প্রদান প্রায় বন্ধই রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত ঔষধ পাওয়া যায় না। আবাসিক রোগীদের নিম্নমানের খাবার ও বিছানাপত্র সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ডাক্তাররা নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ত্যাগ করে তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে চলে যান। তিনি জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরবস্থা এবং ডাক্তারদের অনিয়মের ব্যাপারে এ নিয়ে একাধিকবার উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা হয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদাল মিয়া বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের চাহিদা মত সেবা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত ডাক্তার ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছেন।
তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. পদ্মমোহন সিনহা জানিয়েছেন, সাধ্যানুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে তারা অত্যন্ত আন্তরিক। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানা সংকটের বিষয়ে প্রশাসনিক উধ্বর্তন কর্মকর্তারা অবগত রয়েছেন। এসব সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে।