অরক্ষিত সিলেটের পর্যটন স্পট, ঘটছে একের পর এক প্রাণহানি

downloadসুরমা টাইমস ডেস্কঃ প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি সিলেট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই অঞ্চলে সারা বছরই বেড়াতে আসেন পর্যটকরা। বিভিন্ন ছুটিতে বা উৎসবে এখানকার পর্যটনস্পটগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন পর্যটকরা। তবে পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চললেও সিলেটের প্রায় সবগুলো পর্যটনস্পটই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
এসব স্থানে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা বা সচেতনা সৃষ্টির জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে প্রতিবছরই সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। উৎসবের ছুটিতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ায় বেড়ে যায় প্রাণহানির সংখ্যাও।
সর্বশেষ গত ২২ জুলাই জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে তলিয়ে যায় ঢাকার দুই কলেজ ছাত্র। শুক্রবার রাতে ও শনিবার দুপুরে এই দুই তরুণের লাশ ভেসে ওঠে। এরআগে তিনদিন চেষ্টা চালিয়েও তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
Madhobpur Lakeসম্প্রতি সিলেটে টুরিষ্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু করা হলেও সিলেটের মাত্র তিনটি পর্যটন স্পটে রয়েছে তাদের কার্যক্রম। তাও নেই কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা, পর্যটকদের তুলনায় পুলিশের সংখ্যাও একেবারে অপ্রতুল। ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের সচেতন ও সাবধান করে দিতেও নেই কোনো উদ্যোগ।
তবে পর্যটন পুলিশ, সিলেটের সমন্বয়ক এএসপি একেএম গণিউজ্জামন লস্কর বলেন, সিলেটে আগত পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সর্ম্পকে সাবধান করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। এ জন্য ব্যানার, সাইনবোর্ড ও লিফলেট তৈরি করছেন। যা পর্যটন স্পটগুলো সাটানো ও বিলি করা হবে।
জানা যায়, ২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থা জারির পর সিলেটের পর্যটনস্পটসমূহ পরিচর্যার জন্য সিলেটের পর্যটন শিল্পের উদ্যোক্তা ডা. জাকারিয়া আহমদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হলেও তা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়।
ফলে প্রতিবছরই সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। নিজেদের অসাবধনতা ও কতৃপক্ষের উদাসীনতায় স্ন্দুরের খোঁজে এসে মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নিতে হচ্ছে অনেককে।
Ratargulগত বছর জাফলংয়ে সাঁতার কাটতে গিয়ে সলিল সমাধি হয় পাঁচ পর্যটকরে। এরপর জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ করে জেলা প্রাসশন। পুলিশ ও বিজিবির টহলও জোরদার করা হয় জাফলংয়ে। তবুও জাফলংয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না দূর্ঘটনা। গত বুধবার জাফলং বেড়াতে এসে পিয়াইন নদীতে তলিয়ে যায় কলেজ ছাত্র সোহাগ ঘোষ ও আবদুল্লাহ অন্তর। শুক্রবার রাতে অন্তরের ও শনিবার দুপুরে সোহাগের লাশ ভেসে ওঠে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, জাফলংয়ে পিয়াইন নদীতে গোসল করতে নেমে গত একযুগে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ পর্যটক।
আর মৌলভীবাজার জেলার মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে গত এক যুগে ৩২ জন পর্যটক সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা গেছেন। ২০১৩ সালে ঈদে সিলেটের লালাখালের সারি নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যান তিন পর্যটক। এছাড়া প্রতিবছরই জাফলং, পাংতুমাই, বিছনাকান্দি পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের অসাবধনতায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিলেটের বিভিন্ন ঝর্ণা ও নদীর স্রোতে তলিয়ে গিয়ে ও চোরাবালিতে আটকে পড়ে মারা যান পর্যটকরা।
অথচ কেউ স্রোতে তলিয়ে গেলে দ্রুত উদ্ধারে নেই কোনো ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এ জন্য দক্ষ জনবল সঙ্কট ও ডুবুরির অভাবকে দায়ী করেছেন।
সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, সিলেটের উপ পরিচালক মো: মোজাম্মেল হক বলেন, সারাদেশে প্রশিক্ষিত ডুবুরি রয়েছেন মাত্র ২৫জন। এই সামান্য সংখ্যক ডুবুরি দিয়ে সারা দেশে উদ্ধার তৎপরতা চালানো অসম্ভব। নদীমাতৃক এ দেশের তিনশো ফায়ার ষ্টেশনের জন্য অন্তত: ছয়’শ ডুবুরী নিয়োগের প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
Jaflongসিলেটের রুপে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ নামে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যুগে যুগে মুগ্ধ করেছে দেশ বিদেশের পর্যটকদের। দেশের বৃহৎ দুই হাওর টাঙ্গুয়া ও হাকালুকি, দেশের একমাত্র জলারবন রাতারগুল, জাফলং, বিছনাকান্দি, পাংথুমাই, ভোলাগঞ্জ, লালাখাল, লোভাছড়া, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর জলপ্রপাত, সাতছড়ি ও রেমা কালেঙ্গা উদ্যান এবং বিভিন্ন চা বাগানসহ এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলো দেখতে সবসময় ভিড় করেন পর্যটকরা। শাহাজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) এর মাজার জিয়ারতেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সিলেটে আসেন। প্রকৃতি সিলেটকে দুহাত ভরিয়ে দিলেও এসব সৌন্দর্য সুরক্ষায় নেই কোনো উদোগ। উল্টো অরক্ষিত করে ফেলে রাখায় একেকটিকে পরিণত করা হয়েছে মৃত্যুকুপে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, একমাত্র মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে নির্দেশনা সম্বলিত কিছু সাইনবোর্ড টানানো ছাড়া বাকী কোনো পর্যটন কেন্দ্রেই পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশনা নেই প্রশাসনের। বেড়াতে এসে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না এসব পর্যটকদের জানানো জন্য নেই কোনো Jaflongউদ্যোগ। ফলে পর্যটকরা আনন্দ করতে গিয়ে অনেকসময় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ডেকে আনছেন মৃত্যুকে।
সিলেটের বিছনাকান্দি ও পাংথুমাই গিয়ে দেখা যায়, পর্যটকরা অনেক সময় বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ছেন ভারতের সীমানায়। সীমানা নির্ধারণী কোনো চিহ্ন না থাকায় ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় অনেকে ভুল করে ঢুকে পড়ছেন ভারতে। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বিপদ। এই দুই জায়গার সাঁতার না জেনেও পর্যটকরা ঝর্ণার পানিতে নেমে যাচ্ছেন গোসল করতে। ফলে তীব্র স্রোতের কবলে পড়ে ডেকে আনছেন বিপদ। এসব পর্যটকদের দমানোর জন্য বা তাদের সচেতন করে তোলার জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসায় সিলেটর লালাখাল ও জাফলংয়ের নদীতে প্রায়ই নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। এছাড়া এখানাকার নদীগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে বেশকিছুতে চোরাবালি। ঢল ও চোরাবালির হাত থেকে বাঁচতে পর্যটকদের সচেতন করে তোলার ব্যাপারে নেই কোনো উদ্যোগ। এমনকি কোনো পর্যটক দূর্ঘটনার মুখে পড়লে তকে সাথেসাথে উদ্ধার করার ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতিও নেই স্থানীয় প্রশাসনের। স্থানীয় লোকজন আর শ্রমিকরাই এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা। এরফলে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দূর্ঘটনাকবলিতদের জীবিত উদ্ধারের ঘটনা একেবারেই বিরল।
সিলেটের জলারবন রাতাগুলে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে প্রবেশ জীববৈচিত্রের জন্য হুমকীস্বরুপ হলেও এই বনে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটকরা ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে প্রবেশ করছেন বনে। বিভিন্ন বাধ্যযন্ত্র বাজিয়ে নষ্ট করে ফেলছেন বনের পরিবেশ। এছাড়া খাবারের প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি ফেলে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে বিরল প্রজাতির এই বনটিকেও। এখানেও পর্যটকদের আচরণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে বন বিভাগ ও প্রশাসনের নেই কোনো উদ্যোগ। কর্তৃপক্ষের এই উদাসীনায় যেমন হুমকীর মুখে পড়ছেন পর্যটকরা তেমনি পর্যটনকেন্দ্রগুলোও দিন দিন সৌন্দর্য হারাচ্ছে।
এছাড়া সিলেট শহর থেকে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো গড়ে না উঠার কারনেও বিপাকে পড়তে হচেছ পর্যটকদের।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সদস্য ডা. জাকারিয়া আহমদ বলেন, সিলেটের পর্যটন শিল্পের বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় নিরাপত্তা, যোগাযোগ ববস্থা, পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকার অভাব ও পর্যটনস্পটগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা।
তিনি বলেন, তারপর আশার কথা হলো সিলেটের প্রচুর সংখ্যক পর্যটকরা আসছেন। কিন্তু সমস্যাগুলো দূর করতে না পারলেও আগামীতে আর পর্যটকরা আসবেন না। এবং এটি শিল্প হিসেবেও দাঁড়াবে না।
দুর্ঘটনার জন্য পর্যটকদের সচেতনাকে দায়ী করেন ডা. জাকারিয়া। তিনি বলেন, অনেক সাঁতার না জেনেও নদীতে নেমে পড়ে। ঝর্ণার ঠিক নিচে গিয়ে ধাপাধাপি করে, সীমানা পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে ফেলে। পর্যটকরা সচেতন না হলে তো কিছুই দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না।
পর্যটন পুলিশ সিলেটের সমন্বয়ক এএসপি গণিউজ্জামান লস্কর বলেন, আমাদের প্রধান কাজ মূলত পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়া। এছাড়া পর্যটকদের সচেতন করার কাজও করছি।
তিনি বলেন, সিলেটে আমাদের কার্যক্রম নতুন শুরু হয়েছে। তেমন অবকাঠামো নেই। লোকবলও কম।
গণিউজ্জামান জানান, সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি ও লালাখালে ৪৭ জন পুলিশ সদস্য পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। শীঘ্রই রাতারগুলে টুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হবে।