মা- তুমি সংগ্রামী, তুমি অপরাজিতা : ইসমত পারভীন (রুনু)
পারিবারিক বন্ধন নাকি খুবই সুদৃঢ়। নিজেদের জীবনে তার ছিঁটে-ফোঁটাও উদ্ধার করতে পারিনি। তবে কি পারিবারিক দৃঢ়তার আড়ালে কৃত্রিমতাই তার সবটুকু জায়গা দখল করে নিয়েছে। সম্পর্কের গভীরতা দুর্বল থেকে হচ্ছে আরও দুর্বল। চেনা থেকে অচেনা। আধুনিকতার নামে মানুষের মনকে ভোগবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। দেশ কিংবা সমাজ বা আগামী প্রজন্ম কতটা মূল্যবোধ আর নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে তা আজ ভাবার বিষয়।
শিশুর জন্য পরিবার হচ্ছে তার প্রথম পাঠশালা বা প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। তাছাড়া পরিবার থেকেই শিশুর চরিত্র গঠন ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে কথা বলা, আচার-আচরণ, শিষ্ঠাচার, শৃঙ্খলাজ্ঞান এ সব কিছুরই প্রথম পাঠ পরিবার থেকে। কিন্তু মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা ভাবতে পারছিনা। আমি আমার পরিবারের কথা বলতে পারি বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন নিয়ে আমাদের পরিবার। পারিবারিক বন্ধন ও দায়বদ্ধতা থেকেই নিজেদের মধ্যে তার চর্চাও ছিল। কিন্তু আজ নিদারুণ অসহায়ত্বই কেবল পাথেয়। কেউ কারও নয়। কারও বিপদেই কেউ হাত বাড়াচ্ছে না। কেবল প্রতিযোগিতা অন্যকে পেছনে ফেলবার।
শিশুরা নাকি বড়দের আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই পিতা-মাতা যদি সদাচারী, সহনশীল ও সত্যভাষী হন তাহলে পরিবারের শিশুরাও সেগুলো অনুসরণ করে।
আজকে বারবারই আমার ‘মা’ এর কথা মনে পড়ছে। ‘মা’ তাঁর সবটুকু দিয়ে আমাদের বড় করেছিলেন। তাঁর আদর্শে বড় হয়েছি বলেই আজ মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, পার¯পরিক শ্রদ্ধা, অন্যকে সম্মান করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা, ছোটদের øেহের আবর্তে বেঁধে রাখা এ গুণাবলী নিজের মধ্যে অবলীলায়ই জায়গা করে নিয়েছে। তার মধ্যেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এতটাই চোখে পড়ে তা বর্ণনা করতে রীতিমত আঁতকে উঠছি।
আমার মা সহজ-সরল মনের একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর চাহিদার কোটাও একেবারে শূন্যে। কিন্তু আমার প্রাণপ্রিয় মা জননীর সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক কাছের আপনজনেরা তাঁকে প্রচ-ভাবে ঠকিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। যা আজকে মায়ের অনুপস্থিতিতে ভাবতেও চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। সেজন্য মা সংগ্রামী, অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
সন্তান হিসেবে আমাদের অযোগ্যতা কখনও মায়ের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সময় দেয়া কিংবা প্রতিনিয়ত কাছাকাছি থাকা, এগুলো দ্বিধাহীন চিত্তে, দায়িত্ব নিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সময় কেটে গেছে মায়ের, উৎকণ্ঠা আর অসম্মান নিয়ে ভাবতে ভাবতে।
মায়ের জীবদ্দশায় এত অপূর্ণতা, কোনটা রেখে কোনটা বলবো। অথচ উনি (আমার মা) না থাকলে আমি হয়ত পৃথিবীর আলো দেখতাম না। আমার আমি হয়ে উঠতাম না। মানবিকতা আজ কোথায়? মৃত্যুর পরেও সেই অবহেলা, সেই অসম্মান প্রদর্শন থেমে নেই।
সর্বদাই মাকে বিভিন্ন অপবাদ, অপমান আর অসম্মান নিয়েই জীবনে চলতে হয়েছিল। একটি বারের জন্যও প্রতিবাদ করেননি। আর প্রতিবাদ বা শাসন করবেনই বা কাদের? সবাই তো অমানুষ। খোলস পড়া সমাজের নোংরা কীট।
আজ ইচ্ছেরা খুবই জোর করে মাকে কাছে পেতে, জড়িয়ে ধরতে, আদর করতে, ভালবাসতে, পছন্দের খাবার মুখে তুলে দিতে কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে সবই গুঁড়েবালি। তবে সেই না ফেরার দেশ অচেনা গন্তব্যে যেতে হবে সবাইকে। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকেই নিতে হবে।
আজ অনেক কথাই মনে পড়ে, চোখ খুলতেই যদি দেখতে পেতাম মা বসে আছেন মায়ের নির্দিষ্ট চেয়ারে, মুখে লেগে হাসি আছে। ঠোঁটদুটো টুকটুকে লাল। আধুনিকতার সবটুকু যোগ্যতাই আমার মায়ের ছিল। চলা বলায় কতই না স্মার্ট ছিলেন আমার মা!
আবার কখনও মনে হচ্ছে, শাসন করতো যদি আগের মত। আমি রেগে গেলে খাবারের ওপর সব অভিমান গিয়ে পড়তো। বলতেন, “বোকা মেয়ে, খাবারের ওপর রাগ করিসনা। আয় খেয়ে নিবি”। এখন কত অপেক্ষায় থাকি ফোনের, আদেশের, আবদারের, শাসনের কিন্তু সেসব আর কোনদিনই করবেন না। পাষ- পৃথিবী ‘মা’দের থেকে শুধু নিতে জানে কিছু দিতে জানে না। অবশ্য সব মায়ের বেলায় এ বাক্য প্রযোজ্য নয়। এত সহজেই ধরাছোঁয়ার একেবারে বাইরে চলে গেলেন মা। শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণেও কোন লাভ নেই।
একদিন, দুইদিন, মাস, বছর পেরিয়ে আজ ৩ বছর তোমার অনুপস্থিতিকে শুধু একমাত্র সঙ্গী করে নিরন্তর বয়ে চলা। তাতে নেই কোন আনন্দ, নেই কোন নিরাপত্তা কিংবা নির্ভরশীলতাও শূন্যের কোটায়। সব দিক থেকে জীবন রীতিমতই পরিকল্পনাহীন এক পথচলা। বিপদে কেই মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দেবে সে মানুষটি তুমিই ছিলে। ফোনে সবসময়ই বলতে ধৈর্য ধরতে। আর আজকে ধৈর্য ধরে তোমার কথাই পালন করে যাচ্ছি। তুমি দোয়া করো মাগো, যে খানেই থাকো, আমাদের মনে রেখো। তুমিও ভাল থেকো। আল্লাহ পাক তোমাকে বেহেস্ত নসীব করুক এ কামনা।
সংগ্রামী জীবন তোমার, সেই আদর্শে আমরা অনুপ্রাণিত। হারতে শিখিনি। পরাজিত হতে চাইও না। লড়ছি তোমার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে।
মাঝে মাঝে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, অনেক না বলা কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে “মা, তোমাকে অনেক ভালবাসি”। নিজের অনেক ভালো লাগা, মন্দ লাগা বিসর্জন দিয়ে শুধু অন্যের ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের প্রতি অনেক অবিচার করেছো, মাগো। আজ তোমাকে যেই ভালভাবে বুঝতে শিখেছি, তোমার আনন্দটুকুকে প্রাধান্য দিতে চাইছি; তখন আর তোমাকে আমাদের মাঝে পাবো না, এটা বাস্তবতা কিন্তু মেনে নেয়া বড্ড কষ্টের। তোমার অধিকার, আবদার, এসবের জায়গাটুকুও ছিলো সংকীর্ণ। তোমার ধৈর্য আর দায়িত্ববোধের কারণে আমরা পরিবারে সেই সংকীর্ণ জায়গাটুকু আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাইতো আজ প্রতিজ্ঞার হাত বাড়ালেই তোমাকে পাবো না। এ যেন পরম কষ্টের, বেদনার, পরাজয়ের।
সবকিছু ছাপিয়ে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তোমাকে তোমার মতো করে শান্তিতে রাখেন। যদি পারো তোমার অকৃতজ্ঞ সন্তানদের ক্ষমা করো। তোমাকে খুবই মিস করি। কতদিন ‘মা’ ডাকিনি। ভাল থেকো, আমাদের জন্য দোয়া করো।
লেখিকা: গৃহিণী, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক।
ঠিকানা: ফয়জুন ভিলা (৩য় তলা), এ-১৪ অনামিকা আ/এ, পূর্ব শাহী ঈদগাহ, টিবি গেইট, সিলেট-৩১০০। মোবাইল-০১৭১১১৯৯২৮৯। ই-মেইল: [email protected]