হিন্দুত্ববাদী নীতি থেকে সরে আসছেন নরেন্দ্র মোদি?

modiসুরমা টাইমস ডেস্কঃ মেরুকরণের রাজনীতি কোনোভাবেই তাকে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাহায্য করছে না বলে মনে করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাই সম্প্রতি দলের কয়েক জন শীর্ষ নেতার কাছে তিনি বলেছেন—‘ঢের হয়েছে। আর নয়!’
সরকারি সূত্রের খবর, হিন্দুত্বকে একটি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে না দেখে সঙ্ঘ পরিবারের কেউ কেউ যেভাবে মোদি ও তার সরকারকে উগ্র হিন্দুত্বের পথে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ।
দিল্লির সরকার যখন এক বছর ছুঁতে চলেছে, তখন আর্থিক উন্নয়ন ও বৃদ্ধিকেই অগ্রাধিকার দিতে চাইছেন মোদি। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের কীর্তিকলাপ তার সেই উদ্দেশ্যকেই ঢেকে দিচ্ছে বলে দলের অন্দরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
কখনো সাক্ষী মহারাজ, কখনো সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, কখনো গিরিরাজ সিংহ— একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্যে মোদির বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন দলের নেতারা। এর মধ্যে নিরঞ্জন জ্যোতি ও গিরিরাজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করার পর মোদির চাপেই সংসদে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন গিরিরাজ। এর সঙ্গে রয়েছে ক’মাস আগে উত্তরপ্রদেশে ঢালাও ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচি এবং একের পর এক গির্জায় হামলা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোদি বুঝতে পারছেন, এই সমস্ত ঘটনাই বহির্বিশ্বে তার সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে না। বিশেষত একাধিকবার যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে মোদির উদ্দেশে প্রচ্ছন্ন কড়া বার্তা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
কারো কারো মতে, সাম্প্রতিক বিদেশ সফরেই মোদির তরফে সেই ভাবমূর্তি বদলের প্রয়াস চোখে পড়েছে। ফ্রান্সে ইউনেস্কার সভায় তিনি বলেছেন, সংখ্যালঘু হোন বা সংখ্যাগুরু, সব ভারতীয়র সমান অধিকার চান তিনি। এর পর দেশে ফিরেও এক খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এবং সেই বৈঠকের পরের দিনই অজমির শরীফে মোদির পাঠানো চাদর চড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সবই মোদির সুচিন্তিত কর্মসূচি এবং তা মোটেই আকস্মিকভাবে শুরু হয়নি। তাদের মতে, মূলত দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি ধরাশায়ী হওয়ার পর থেকেই মোদী এ দিকে বিশেষ নজর দিতে শুরু করেন (উল্লেখ্য, মোটামুটি ওই একই সময়ে ভারতে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিয়ে মোদিকে কার্যত তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ওবামা)।
এরপর বেঙ্গালুরুতে দলের কর্মসমিতির বৈঠকে আরো একটি চোখে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু সেখানে রাজনৈতিক আলোচনার সময়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বলেন, ‘যারা ধর্মান্ধ হয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন, তারা বিজেপিকে নয়, দেশকে ধ্বংস করছেন। আমরা এ ধরনের বিবৃতি বরদাস্ত করব না। বিজেপি কোনো দিনই সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না।’
বেঙ্কাইয়ার এই বক্তব্য শুনে উপস্থিত নেতাদের অনেকেরই মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন ছাড়া কোনো মতেই এতটা সাহস দেখাতে পারতেন না তিনি। বস্তুত, বেঙ্কাইয়া সম্পর্কে বিজেপি মহলে কথিতই রয়েছে, মোদিকে না জানিয়ে কোনো কাজই করেন না দলের এই প্রাক্তন সভাপতি। আরো তাৎপর্যপূর্ণ হল, বেঙ্কাইয়ার এই বক্তব্যকে সে দিন সমর্থন করেছিলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।
লোকসভা নির্বাচনের আগে অবশ্য অমিত শাহের বিরুদ্ধেই উত্তরপ্রদেশে মেরুকরণের রাজনীতির অভিযোগ উঠেছিল। এমনকি সভাপতি হওয়ার পরেও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে তিনি একই পন্থা নিয়েছিলেন বলে মনে করেন কেউ কেউ। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, এই পরিবর্তিত রণকৌশল কি একান্তভাবেই মোদীর মস্তিষ্কপ্রসূত?
বিহারে বিধানসভা ভোট হতে আর মাস ছয়েক বাকি। বরাবরই জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট হয় সেই রাজ্যে। মোদি-বিরোধিতায় সম্প্রতি অভিন্ন জনতা পরিবারের ছাতার তলায় এসেছেন লালু প্রসাদ, নীতীশ কুমার ও মুলায়ম সিংহ। সে ক্ষেত্রে অনেকেরই কৌতূহল হল, মোদি কৌশল পাল্টালে এ বার কি বিহারের ভোটে মেরুকরণ দেখা যাবে না? কেউ কেউ আবার মনে করেন, মোদির ভবিষ্যৎ ভাবনায় রয়েছে বিহারের পরে ভোটের পথে হাঁটতে চলা আরো দু’টি রাজ্য— তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ।
ওই দুই রাজ্যেই সাধারণত মেরুকরণের রাজনীতি প্রভাব ফেলে না। তাই উন্নয়ন ও স্বচ্ছ প্রশাসনের প্রতিশ্রুতিকে হাতিয়ার করেই ওই দুই রাজ্যে ভোটে যেতে চান মোদি।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ নেতা, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে এক চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কট্টর হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের কেন বিতাড়িত করছেন না মোদি? সরাসরি জবাব এড়িয়ে জেটলিও বলেছেন, এই ধরনের উগ্র হিন্দুত্বের লাইনকে তারা কোনো দিনই সমর্থন করেননি। তিনিও মনে করেন, উন্নয়নই প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার।
বিজেপি-বিরোধী নেতারা বলছেন, মোদীর এই ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নের ধ্বজা ওড়ানোর গোটাটাই নাটক। কংগ্রেস নেতারা বলেন, বেড়াল মাছ খাবে না, এটা হতে পারে না। কারণ অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণীর জমানাতেও বিজেপি একই ধরনের দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে চলেছে। বাজপেয়ী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মুখ। আডবাণী-উমা ভারতীরা সেখানে কট্টর হিন্দুত্বের লাইন ধরে চলেছেন। ফলে মোদী মুখে যা-ই বলুন, তাতে পরিস্থিতির বদল হবে না।
যদিও জেটলিদের মতে, সাক্ষী মহারাজ, সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি বা গিরিরাজ সিংহের মতো নেতাদের বিক্ষিপ্ত মন্তব্যে সংসদ তথা দেশ চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। সেই কারণেই সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি নেতারা যখনই বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, তখনই তাদের ভর্ৎসনা করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।
তবে দলীয় সূত্রের খবর, আগামী চার বছর সরকারের উপরে সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে না বলেই সম্প্রতি এক বৈঠকে অমিত শাহকে আশ্বাস দিয়েছেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। আবার জেটলিরাও মহারাষ্ট্রে গরু জবাই বন্ধের মতো সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। কারণ এটি সঙ্ঘেরই অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা